ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা ও প্রাণের অস্তিত্ব

খন্দকার আপন হোসাইন

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা ও প্রাণের অস্তিত্ব

১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস

প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস-২০২৪ এর পূর্বনির্ধারিত থিম হচ্ছে ‘মন্ট্রিল প্রোটোকল : অ্যাডভান্সিং ক্লাইমেট অ্যাকশন।’ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা ঘটাতে সূর্যের আলোর ভূমিকা সর্বাগ্রে বিবেচ্য। সূর্যের আলো ব্যতীত পৃথিবীতে জীবনধারণ অসম্ভব। কিন্তু সূর্য থেকে নির্গত অতি বেগুনি রশ্মি আবার প্রাণীকুলের প্রাণনাশের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। সূর্য নিসৃত এই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে অবস্থান করে ওজোন স্তর।

ওজোন স্তর না থাকলে সূর্য থেকে নির্গত শক্তি পৃথিবীকে প্রাণহীন গ্রহে পরিণত করে দিতে পারে। ওজোন নামক এই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক স্তরটিই পৃথিবীকে সূর্যের ক্ষতিকারক অতি বেগুনি বিকিরণ থেকে রক্ষা করে। 
১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৬ সেপ্টেম্বর দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পৃথিবীতে জীবন সুরক্ষার জন্য ওজোন স্তর কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে ওজোন স্তর সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যালোচনা করে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল : এ গ্লোবাল রেসপন্স টু এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিস’ নামক আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্তর্জাতিক মহলের নানাবিধ আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণা চলাকালীন একটা পর্যায়ে ওজোন স্তর সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে সকল বুদ্ধিজীবী মানুষের সমর্থন স্থির হয়। মানবসৃষ্ট রাসায়নিক কার্যক্রম ওজোন স্তরের আচ্ছাদন যতটা নষ্ট করেছে তা মেরামতের ব্যাপারে সবাই একমত পোষণ করে।
গ্রিন হাউস প্রভাব সৃষ্টিতে ওজোন গ্যাসের  অবদান আট শতাংশ। বিভিন্ন মোটরযান, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শিল্পে ফসিল জ্বালানির দহনের ফলে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড  উৎপন্ন হয়। এভাবে উৎপন্ন নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ বায়ুম-লের হাইড্রোকার্বন ও অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোন সৃষ্টি করে। ট্রোপোস্ফিয়ারের বহু স্থানে ওজোন গ্যাসের বছরে গড় বৃদ্ধি হার শূন্য দশমিক চার শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত।

তিনটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত একটি সক্রিয় গ্যাস হচ্ছে ওজোন। পৃথিবীতে বায়ুম-লের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। বায়ুম-লের এই স্তরসমূহ মানবজাতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর মাটি থেকে ঠিক উপরের প্রথম স্তরটি ট্রোপোস্ফিয়ার। তার উপরের স্তরে বা ভূস্তরের ৫০-৬০ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার।

স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের একটু নিচের অংশ বা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৫-৩৫ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটিই ওজোন স্তর। প্রাকৃতিকভাবে ওজোন স্তরের এই সুরক্ষাকবচ আমাদের মাথার উপরে না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকতে পারত না। ওজোন স্তরের এই পর্দা ৯৭-৯৯ শতাংশ অতিবেগুনি রশ্মি শোষণে সক্ষম। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীর মাটি, পানি, আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করা যে কোনো প্রাণের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই রশ্মি যত বেশি পৃথিবীর ভূস্তরে পৌঁছবে ক্ষতিও তত বেশি হবে। মানুষের ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্যানসার হয় ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও এর প্রভাবে উদ্ভিদ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। 
পৃথিবীর বায়ুম-লের উপরে অবস্থিত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ওজোন গ্যাসের আবরণ পাতলা হলেও খুব কাজের। সূর্যের আলো বা তাপ এই পাতলা আবরণ ভেদ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করে। চাঁদ-তারার আলোও এই আবরণ ভেদ করেই আসে। ওজোন স্তরের এই পাতলা আবরণটিও মূলত ক্ষতিকর রশ্মিগুলো আটকে দেয়। যা না থাকলে পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বই থাকত না।

মানবসৃষ্ট রাসায়নিক আবিষ্কার ও ব্যবহারের মাধ্যমে এই রক্ষাকবচ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। শিল্প-কলকারখানা ও আধুনিক জীবনের সুবিধা নিতে গিয়ে ওই পাতলা চাদরটি ছিদ্র করে ফেলেছে মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণÑ দুই মেরুতেই ছিদ্র হয়ে গেছে ওজোনের স্তর। দক্ষিণ মেরুর আকাশে তুলনামূলকভাবে বড় ছিদ্র হয়েছে। ষাটের দশকের শেষ থেকেই ওজোন স্তর ছিদ্র হতে শুরু করে।

মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে ক্রমশ বাড়ছে উষ্ণায়ন। বেশ কিছু ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, ব্রোমিন, ক্লোরিন গ্যাস এর জন্য দায়ী। গত কয়েক দশকে বাতাসে এই সব গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে। বেড়েছে ওজোন স্তরের ছিদ্রও। যার প্রভাব পড়েছে জীবজগতে। ছিদ্র সৃষ্টির জন্য ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি আরও বেশি ঢুকছে পৃথিবীতে। ফলশ্রুতিতে ত্বকের ক্যানসার, চোখের ছানির সম্ভাবনা বেড়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইমিউন সিস্টেমের। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গাছপালাও। তবে সঠিক সময়ে সতর্ক হওয়ায় ওজোন স্তরের ক্ষতি পূরণ হতে শুরু করছে। এক গবেষণায় এসেছে ২০০০ সাল থেকে প্রতি দশকে ১-৩ শতাংশ হারে ওজোন স্তরের ক্ষত কমছে। এ ভাবে এগোলে, ২০৩০ সালের মধ্যে উত্তর গোলার্ধে, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ গোলার্ধে এবং দুই মেরু অঞ্চলে ২০৬০ সালের মধ্যে ওজোন স্তরের ক্ষত পুরোপুরি নিরাময় হতে পারে।

তবে হতাশাজনক হলেও সত্য মন্ট্রিল চুক্তি ভেঙে কিছু কিছু দেশে এখনও সিএফসি-১১ গ্যাসটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সিএফসি গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না হলে ওজোন স্তরের ক্ষত-মেরামতের প্রক্রিয়াটি ৭ থেকে ২০ বছর পিছিয়ে যাবে। 
ওজোন স্তর রক্ষায় বায়ুম-লের বিস্তৃত সিএফসি গ্যাস শোষণ করে নিঃশেষ করতে হলে প্রচুর বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি অবশ্যই সিএফসি গ্যাসসহ কার্বন-ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। কল-কারখানার সমৃদ্ধির জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। যানবাহন ও শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়ার প্রকোপ বন্ধ করতে হবে।

তা না হলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে প্রায় এক মিটার। ফলে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি প্লাবিত হবে। ওজোন স্তর রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাবে। ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় দুই মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিশ্বের নি¤œাঞ্চলসমূহ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। 
১৯১৩ সালে ফরাসি পদার্থ বিজ্ঞানীদের একটি দল আবিষ্কার করেন, ওজোন স্তর সূর্যের মিডিয়াম ফ্রিকোয়েন্সির অতিবেগুনি রশ্মির ৯৭-৯৯ শতাংশ শোষণ করে। কোন প্রক্রিয়ায় ওজোন স্তরের আবরণ নষ্ট হয়ে যায় তা বিস্তারিত জানা যায় ১৯৭৪ সালের জুন মাসে বিখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে। মারিয়ো জে মলিনা এবং শেরউড রোল্যান্ড নামক দুই রসায়নবিদের তিন পাতাবিশিষ্ট সেই গবেষণাপত্র পৃথিবী সুরক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বাণী প্রচার করে।

গবেষণায় প্রমাণ করা হয় ওজোন স্তরে রয়েছে পর্যাপ্ত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি গ্যাস)। সিএফসি গ্যাসের ফলে ওজোন গ্যাস একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যায়। মলিনা ও রোল্যান্ড বিষয়টির প্রভূত গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল শুধু বিজ্ঞানীগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ও জীবন সুরক্ষার নীতি-নিয়ামকদের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ‘সুজান সলোমন’ তার গবেষণায় বায়ুম-লের ওজোন স্তর যে সত্যিই সিএফসি গ্যাসের কারণে ক্ষয়ে যাচ্ছে তা প্রমাণ করেন। যা মলিনা ও রোল্যান্ডের আবিষ্কারকে বৈধতা প্রদান করে। আশির দশকে বিশ্বজুড়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সিএফসি গ্যাস প্রচুর ব্যবহার হচ্ছিল।

পরিবেশবিদদের আন্দোলন এবং  মলিনা-রোল্যান্ডের যুগান্তকারী আবিষ্কারের সঙ্গে ‘মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল’-এর প্রচেষ্টায় ওজোন বিনষ্টকারী রাসায়নিকের ব্যবহার পঁচিশ বছরের মধ্যে প্রায় আটানব্বই শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মত, ২০৭৫ সালের মধ্যে ওজোন স্তরের ক্ষয় সম্পূর্ণ মেরামত করা সম্ভব হবে।
ক্লোরিনঘটিত রাসায়নিক যৌগসমূহ বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুম-লের ওপরের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জমা হয়। সেখানে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা অতিবেগুনি রশ্মি ওই ক্লোরিনঘটিত যৌগগুলোকে ভেঙে দেয়। আর তার ফলে বেরিয়ে আসে ক্লোরিন গ্যাসের অণু। সেই ক্লোরিন অণুই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে থাকা ওজোন স্তরটিকে ছিদ্র করে চলেছে। তার পরিমাণ যত বেড়েছে ওজোন স্তরের ছিদ্রও তত বেড়েছে। ওই ওজোনই অতিবেগুনি রশ্মি ও মহাজাগতিক রশ্মিকে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পরে ক্লোরিনঘটিত রাসায়নিক দ্রব্য অর্থাৎ ক্লোরোফ্লুরোকার্বন তৈরি প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে বলা যায়। ২০০৫ সাল থেকেই ওজোন স্তর মেপে চলেছে নাসা। নাসার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্যমতে পৃথিবীর বায়ুম-লের ওপরের ওজোন স্তরে ক্লোরিনঘটিত যৌগের পরিমাণ কমার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে নাসা। এই সুসংবাদটিই হচ্ছে ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বিশ্ব ওজোন সুরক্ষা দিবসের সাফল্য।

লেখক : শিক্ষক

[email protected]

×