ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা  আমদানিনির্ভরতা উপশমকারী

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা  আমদানিনির্ভরতা উপশমকারী

বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হলেও  খাদ্যশষ্য আমদানি করতে হয়

বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হলেও  খাদ্যশষ্য আমদানি করতে হয়। তাই আমদানি নির্ভরতা কমাতে ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় উৎপাদনশীলতা কম। যে হারে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে উৎপাদন বাড়ছে না। কৃষি জমির পরিমাণও বাড়ছে না; বরং কমছে।

তাই কৃষি খাতে গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন বীজ উদ্ভাবন ও যান্ত্রিক সহায়তা নিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বানও জানান তিনি। গভর্নর আরও বলেন, কৃষিকাজ করে তেমন মুনাফা হয় না। তাই এ খাতে নতুন করে মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে না। এই খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। কিন্তু এখনো বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। কৃষিতে যেন মানুষ আকৃষ্ট হয়, সে বিষয়টা সরকারকে দেখতে হবে। প্রতিবছরই আমাদের কৃষিঋণ বিতরণ বাড়ছে। আমরা একটি স্টাডি শুরু করেছি। যার মাধ্যমে দেখা হবে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ পাচ্ছেন কি না। কৃষিতে সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের ৩৮ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রাকে বিশাল বলে আখ্যায়িত করেছেন গভর্নর। দেশের কৃষিঋণের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ব্যাংকগুলোর জন্য এই লক্ষ্য অর্জন করা কিছু নয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হতে কৃষিঋণ আরও অনেক গুণ বাড়াতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য কৃষিনীতিতে কী ধরনের সুযোগ রাখা হয়েছে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, নীতিমালাটা বন্যা শুরুর আগেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তাই এখানে বন্যাকবলিত এলাকার জন্য আলাদা কিছু নেই।

তবে খুব শীঘ্রই সার্কুলারের মাধ্যমে ওই এলাকার কৃষকদের বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। উল্লেখ্য যে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গত অর্থবছরে কৃষকদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের। নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্য গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ কোটি টাকা বেশি ।

এবার চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এক হাজার ৪৭ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়নের নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রথম ও প্রধান তিনটি লক্ষ্য তথা দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃষিঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ৩৪ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন কৃষি ও পল্লীঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও এমএফআই লিংকেজের মাধ্যমে ৩৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ জন ঋণ পেয়েছেন। ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৩  নারী ১২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লীঋণ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হবে। আগে তা ছিল ৩০ শতাংশ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে নতুন করে কয়েকটি বিষয় যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে নতুন কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পল্লী অঞ্চলে আয়-উৎসারী কর্মকা-ে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ লাখ টাকা। ছাদ কৃষিতেও অর্থায়ন করতে পারবে ব্যাংক। অর্থাৎ বাড়ির ছাদে বাগান করতে ঋণ পাবেন গ্রাহক।

এছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রার বাইরে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড তাদের নিজস্ব অর্থায়নে যথাক্রমে ২৬ কোটি টাকা ও এক হাজার ৪২৩ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ) ব্যবহার করতে পারবে। এবারে প্রথমবারের মতো অনেক কৃষি পণ্যের জন্য ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাদ কৃষি, ভেনামি চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষ। শস্য ও ফল চাষের আওতায় কালো ধান, এ্যাভোকাডো ফল ও পাতি ঘাসের জন্যও ঋণ দেওয়া যাবে। নারীসহ চরাঞ্চল, হাওড় ও অনগ্রসর প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণে দেওয়া হবে অগ্রাধিকার। 
বিগত সময়ের দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাসহ খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার সতর্কবার্তাও উচ্চারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে।

সেই আশঙ্কা আমলে নিয়ে বর্তমান সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। ধান-চাল-শাকসবজি-ফলমূল ও মাছ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর হলেও গম-ভোজ্যতেল-চিনি-ডালসহ কিছু নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয় এখনো। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব ঘাটতিও অন্তত কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। সরকারের উপদেষ্টা বারবার দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। ধান-চালের পাশাপাশি গম, তেলবীজ ও অন্যান্য সহযোগী ফসল উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

কৃষি ও জনবান্ধব এই আবেদনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, দেশে কৃষিঋণ বিতরণে গতি বেড়েছে ইতোমধ্যে। স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা হয়েছে কৃষকের জন্য। এর পাশাপাশি সরকার গত বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দিয়েছে ২৭ লাখ কৃষককে। এর আওতায় প্রত্যেক কৃষক বিঘাপ্রতি চাষের জন্য ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার পেয়েছেন বিনামূল্যে। দেওয়া হয়েছে কৃষি যন্ত্রের সুবিধাও।

সবাইকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি এবং মূল চালক। করোনা অতিমারির ভয়ংকর দুর্বিপাকসহ বিভিন্ন জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দাবস্থা সর্বোপরি খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দিন-রাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মানুষকে। কৃষি ও কৃষকরাই নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে।

দেশ বর্তমানে খাদ্য বিশেষ করে ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য মজুতও সন্তোষজনক। ফলে, খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই দেশে। সংকট মোকাবিলায় প্রধান উপদেষ্টা সর্বাধিক জোর দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর।
বন্যা-খরা বাংলাদেশের কৃষির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বন্যায় দেশের ১২ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সব জেলায় এখনও পানিবন্দি রয়েছেন ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। বন্যায় দেশের মোট ১২টি জেলার ৬৮টি উপজেলার ৫০৪টি ইউনিয়ন/পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। বন্যায় ৫৯ জন মারা গেছেন।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের এ পর্যন্ত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা নগদ, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য (উৎস : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়)। অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। এ দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর।

এছাড়াও দুই জেলার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে, শুধু ফেনী জেলায় অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফেনীর ছয় উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার বেশি। এসব এলাকার কৃষিজমিতে তিন-চার ফুট বালি জমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ফসল উৎপাদনে।

চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও উপজেলাগুলোয় কৃষিতে মোট ৩৯৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্যমতে, বন্যাকবলিত জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে ৬০৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অন্যদিকে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কুমিল্লার এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লার ৯৬৮ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুটি ব্রিজ ও ২৬টি কালভার্ট ভেঙে গেছে। এদিকে নোয়াখালীর মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর) ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের সময় সাগরের লবণাক্ত পানি নদীতে ঢুকে যাচ্ছে। এতে কৃষিজমি ও মাছ আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নদীভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে।

এছাড়া রেগুলেটরের ওপর নির্মিত রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় ব্যাহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলাজুড়ে ১৮ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগকবলিত জনসংখ্যা ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এ জেলার কৃষি, পানিসম্পদ খাতসহ মৎস্য খাতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন কৃষক, মৎস্যচাষী ও পশু-পোলট্রি খামারিরা। লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা এখনো পানির নিচে।  এ পরিস্থিতিতে দুর্গত সব এলাকার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উৎপাদন ঠিক রাখা জরুরি। এজন্য কৃষককে পুনর্বাসনে আশু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

কৃষককে বীজ ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণসহ আর্থিক সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি জোর দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত ও ভেঙে পড়া সড়ক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে। কেননা, যাতায়াতের পথ সুগম না হলে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনীতিতে খাত ওয়ারি এত বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও এই ঋণের বিনিয়োগ এত কম কেন এবং জাতীয় বাজেটের আলোকে এই খাতের বরাদ্দ অগ্রাধিকার তালিকায় আসে না কেন? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশের ৪১ লাখ গ্রামের পরিবার ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদন করলেও সফল হতে পারেনি এবং এর কারণ হিসাবে ব্যাংকের অনীহা ও প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

এরপরও ঋণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, পদ্ধতিতে ত্রুটি ও অলিখিত লেনদেন  খরচ ক্রমাগত ভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর এই কৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারছে না। অথচ কৃষকদের ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যেমনÑ বিকেবি ও  রাকাব রয়েছে। তাছাড়াও অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের কমপক্ষে ৫ শতংশ কৃষি খাতে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্পকে দেওয়া ঋণ কৃষিঋণ হিসাবে অন্তর্ভক্ত করে এ নিয়ম পরিচালনা হয়েছে বলে দেখায়। বর্তমানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের ওপরে সুদ হার নির্ধারণ করে দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু একে লাভজনক বলে মনে করে না বিধায় ব্যাংকগুলো এজেন্সি  ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনজিওদের সঙ্গে চুক্তিবব্ধ হয়ে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর ব্যাংকগুলো লাভবান হয়।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরএ) এর এক পতিবেদনে বলা হয়েছে, এনজিওগুলো থেকে যে কৃষিঋণ বিতরণ হচ্ছে, তার বেশির ভাগ কৃষি কাজে ব্যয়িত না হয়ে অন্য খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বিবিএসের তথ্যমতে, মাত্র ১১ শতাংশ কৃষক তাদের ঋণের অর্থ কৃষি কাজে ব্যবহার করছে। আবার গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যয় করছে প্রায় ৩৮ শতাংশ কৃষক পরিবার। এ তো গেল সনাতনী কায়দায় কৃষি ঋণ নীতিমালা বাস্তবায়ন ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত রোজনামচা।

এর একটি সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কারণ, ঋণের যে গতি প্রবাহ, যা কর্মসূচি ভিত্তি ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবারতান্ত্রিক কৃষির ব্যবস্থার হয়তো কিছুটা উপকার আসবে, কিন্তু কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে কিংবা কৃষির আধুনিকায়নে তেমন কোনো অবদান রাখার সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
এখন  নবনিযুক্ত গভর্নর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নীতিমালাকে কিভাবে  স্বনির্ভর নীতিতে পরিণত করবেন এবং আমদানি নির্ভরতা উপশমকারী হিসাবে কাজ করবে, তা ভেবে দেখার বিষয়।  যেমন-  প্রথমে প্রয়োজন হবে ঋণের পরিবর্তে বিনিয়োগ, যাকে বলা হবে কৃষি বিনিয়োগ নীতি। এর আওতায় গ্রিন হাউসভিত্তিক শস্য ও শাকসবজি উৎপাদন স্কিম গ্রহণ করতে হবে, যা হবে সারা বছরভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম।

দ্বিতীয় প্রসংগটি হলো কৃষিঋণ নীতিতে শতকরা ১০ ভাগ  বরাদ্দ রাখা হয়েছে মৎস্য ও পশুসম্পদ খাতে। এখানে উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলছে মৎসবিজ্ঞানীরা । দেশের মৎসচাষিরা বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতগুলো সঠিক ভাবে চাষ করে দেশের মৎস খাতকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করছে সত্যি, কিন্তু মাছের খাবারের মূল্য ও পুকুর সেচসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে  অর্থ জোগান করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, তা শতকরা দশ ভাগ কৃষিঋণ দিয়ে পোষাচ্ছে না।

এই বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ভাবে মনোযোগী হবে বিশেষত কৃষিঋণ নীতিমালায়। তৃতীয়ত,  কৃষি উপখাত প্রাণিসম্পদ  একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেখানে শতকরা দশ ভাগ ঋণ বরাদ্দ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। কারণ, আমাদের খাবারের আমিষ জোগান ও খাদ্যপুষ্টির মান নির্ণয়ে এই খাত অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে প্রাণিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি কৃষক পরিবার, যা কর্মসংস্থানের একটি বড় উপযোগ; চতুর্থত,  আর্থিক অন্তর্ভুক্ত বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি, যার প্রচার ও প্রসার উভয়টি হলেও কৃষিঋণ নীতিতে তার তেমন কোনো উল্লেখ নেই। ফলে, এই কার্যক্রমে স্থবিরতা লক্ষণীয়।

এই বিষয়গুলো কৃষিঋণ নীতিমালায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হওয়া উচিত; পঞ্চমত,  কৃষিঋণ নীতিতে কেবল ঋণ বিতরণের কথাই উল্লেখ থাকে, আদায়ের তেমন তত্ত্ব-উপাত্ত দেখা যায় না। দেশের সার্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় পরিমাণের দিক থেকে কৃষি ও পল্লীঋণ একেবারেই নগণ্য এবং সেই হিসাবে বৃহদাকার ঋণের ঝুঁকি তথা আদায় বা অনাদয়ী সংকট দেশের ঋণখেলাপির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। এ অবস্থায় আনুপাতিক হারে কৃষি/ পল্লীঋণ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।  

তাই আসুন, কৃষিঋণ নীতিমালায় উল্লিখিত অধ্যায় বা ধারাগুলোকে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা ,কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিয়ে যাবেÑ এই প্রত্যাশা রইল।


লেখক :  অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা

×