ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

মহানবীর (সা.) মহা জন্মোৎসব

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মহানবীর (সা.) মহা জন্মোৎসব

১২ রবিউল আউয়াল

১২ রবিউল আউয়াল। কুল মাখলুকাতের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এদিনে তিমির আকাশে উদিত হয়েছিল এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র- আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে পুর নূর (সা.) এ বিশ্বচরাচরে তাশরিফ আনেন। তাঁর শুভাগমনে এ পৃথিবী থেকে হাজার বছরের গুমোটবাঁধা জুলমাত ও অন্ধকার বিদূরিত হয়, সমুদয় অজ্ঞতা ও পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আরব আযমে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা।

মানব-দানব, পশু-পাখি তামাম সৃষ্টিকুলে সেদিন নেমে এসেছিল পরম স্বস্তি, শৃঙ্খলা, সাম্য, শান্তি ও পারস্পরিক মমত্ববোধের পরিবেশ। আমাদের ঐতিহ্যের ভাষায় এদিন পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.)। আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পুর নূর (সা.) এর মহান জন্মোৎসব। এ উৎসব অবিস্মরণীয় অতুলনীয়, চিরঞ্জীব চির সজীব। এ উপলক্ষে আজ ছুটির দিন। মানবতা যেন এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সে অপেক্ষমাণ দিনটি। 
সেদিন পৃথিবীতে যেমন রাহমাতুল লিল আলামীনের শুভ আগমনে ঈদের আনন্দ বয়ে গিয়েছিল, উদ্বেলিত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল গোটা কায়েনাত; আমরাও আজ সেদিনের স্মরণে পরম আনন্দ উপলব্ধি করছি, শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আলাহ পাক সুবহানাহু তায়ালার। অযুত কণ্ঠে সালাত ও সালাম জানাই নবী করিম (সা.) এর পাক চরণে। আমাদের মহান জাতীয় কবি নবী প্রেমিক নজরুল আজকের এ মহান দিবস উপলক্ষে সুন্দর বলেছেন-  
‘নাই তাজ, তাই লাজ- ওরে মুসলিম খর্জুর শীষে তোরা সাজ 
উরজ য়্যামান নজদ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম, 
মেশের ওমান তিহারান-স্মরি কাহার বিরাট নাম,
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’
অবশ্য আল্লাহ পাকের রহমত ও নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর পবিত্র জীবনের অলৌকিকত্ব যে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের এই দিনেই তিনি মদিনায় হিজরত করেছিলেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের এদিনে আবার তামাম মাখলুকাতকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাদিস শরীফে এসেছে : নবীজীর পয়দায়েশ উপলক্ষে আজ থেকে প্রায় ১৪শ’ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মানব দানব জীবজন্তু গাছপালা সবই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। 
৬৩ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এই দিন তিনি আবার ওফাতপ্রাপ্ত হন। আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে চলে যান। হাদিস শরীফে এসেছে : আঁ হজরতের তিরোধানে সেদিন আকাশ বাতাস হয়ে পড়েছিল মেঘাচ্ছন্ন ও শোকাতুর। তাই একাধারে এ সময় মুমিনের আঁখি যুগল দিয়ে নির্গত হয় আনন্দাশ্রু। নবীজীর জন্মের আনন্দ, তাঁর দাওয়াত ও বিজয়ের আনন্দ; আবার কর্ম শেষে তাঁর ত্যাগ ও ভালোবাসার মহা অধ্যায় স্মরণ আর রাজদূতের মতো চিরবিদায় গ্রহণের কাহিনী আমাদের কাঁদিয়ে ছাড়ে।

আগেই বলেছি, মহানবী (সা.) এর জন্ম ও ওফাতের  এ দিবসে আমরা মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করে থাকি। এদিন, এ মৌসুমে স্মরণ করি তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ, ত্যাগ ও মহত্ত্ব। তিনি গোটা জীবন তাওহীদ বা মহান আল্লাহ তায়ালার কালেমার দাওয়াত দিয়ে মানুষকে সৎ পথের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল মানব জাতির আদর্শ ও হিদায়াত। দূর করেছিলেন শিরক - বিদআত গোমরাহি আর জুলমাতের কালিমা।

আমরা আজ স্মরণ করি তাঁর হাতে গড়া মদিনা রাষ্ট্র, তাঁর পুণ্যাত্মা সাহাবাদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত খিলাফতে রাশেদা। আমরা উপলব্ধি করি তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবাদের আদর্শের মধ্যেই আমাদের সকলের জন্য নিহিত রয়েছে অফুরন্ত দুনিয়াবী কল্যাণ ও শান্তি এবং আখিরাতের নাজাত ও পুরস্কার। 
মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করছেন : তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল দয়াময়। এতদসত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে হে প্রিয় নবী! আপনি বলে দিন: আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারও বন্দেগী নেই।

আমি তারই ভরসা করি এবং তিনি মহান আরশের অধিপতি। (সূরা তাওবা আয়াত ১২৮ ও ১২৯)। এ আয়াত দুটোতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দুনিয়াতে তাশরিফ আনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তামাম জাহানের জন্য রহমত ও দয়ার আধার হয়ে প্রেরিত। বিশেষ করে বিশ্বাসীদের জন্য একজন মহা মঙ্গলকামী পথনির্দেশক। আমাদের উচিত মহান আরশের অধিপতি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে এবং দুনিয়া আখিরাতের মঙ্গলের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করা, সর্বাধিক ভালোবাসা নিবেদন করা এবং জীবনে সর্বক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা। 

সূরা আহযাব ৫৬ ও ৫৭ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে : আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ তোমরা নবীর জন্য রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি যথাযথ সালাম প্রেরণ কর। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। 
উপরোক্ত আয়াতের আসল উদ্দেশ্য, মুসলমানদের রাসূলে খোদা (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করার আদেশ দান করা। কিন্তু তা এভাবে ব্যাক্ত করা হয়েছে যে, প্রথমে আল্লাহ স্বয়ং নিজের ও তাঁর ফেরেস্তাগণের দরূদ পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর সাধারণ মু’মিনগণকে দরূদ প্রেরণ করার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর মাহাত্ম্য ও সম্মানকে এত উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে যে, আঁ-হজরত (সা.)-এর শানে যে কাজের আদেশ মুসলমানদের দেওয়া হয় সে কাজ স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেস্তাগণও করেন।

অতএব যে মু’মিনগণের প্রতি রাসূল (সা.)-এর অনুগ্রহের অন্ত নেই তাদের তো এ কাজে খুব যতœবান হওয়া উচিত। এ বর্ণনাভঙ্গির আরও একটি উপকারিতা এই যে, এতে করে দরূদ সালাম প্রেরণকারী মুসলমানদের একটি বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তাদের এমন এক মহতী কাজে শরিক করে নিয়েছেন যা তিনি নিজেও করেন এবং তাঁর ফেরেস্তাগণও। আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করেছে।’
সাহাবী উবাই ইবনে কা’ব (রা.) বর্ণনা করেন : আমি হুজুর (সা.)-এর খিদমতে আরজ করলাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমি আপনার খিদমতে অনেক দরূদ পাঠ করি। আপনি বলে দিন যে, নিয়মিতভাবে আমি আপনার প্রতি কতবার দরূদ পাঠ করব? হজরত (সা.) জানালেন; যত তোমার ইচ্ছা। অতঃপর আমি আরজ করলাম যে, আমার অজিফার জন্য নির্ধারিত সময়ের এক-চতুর্থাংশ সময় আমি আপনার ওপর দরূদ পাঠ করতে চাই। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করলেন : যতক্ষণ তোমার খুশি পাঠ কর। তবে আরও কিছু সময় বৃদ্ধি করতে পারলে তা তোমার জন্য হবে কল্যাণকর। আমি আরজ করলাম : তাহলে মোট সময়ের অর্ধেক।

জবাবে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবীব বললেন : যা তোমার ইচ্ছা। তবে যদি আরও কিছু সময় বৃদ্ধি কর, তা তোমার জন্য আরও ভালো হবে। আমি আরজ করলাম যে, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ সময় ধরে পড়ব। হজরত (সা.) এবারও জানালেন: যা তোমার খুশি। তবে আরও কিছু সময় বাড়াতে পারলে তা তোমার জন্য আরও ভালো হয়। আমি এবার জানালাম : আমার ওপর অজিফার সবটুকু সময় আপনার ওপর দরূদ পড়ে অতিবাহিত করতে চাই। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করলেন : এমন অবস্থায় তোমার সকল ভাবনা ও প্রয়োজনীয় হাজত পূরণ করা হবে এবং তোমার সকল গুণাহ মাফ করা হবে। (তিরমিজী শরীফ)।
রাসূল (সা.) এর পবিত্র পয়দায়েশ ওফাতের এ মহান দিবসে আমাদের নবীজীর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানার জন্য নতুন করে প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। তাঁর হায়াতে তাইয়্যিবা আমাদের জন্য ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’্-দুনিয়ার জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর আদর্শ ও পথনির্দেশ। তাঁর স্মরণ আমাদের জন্য বরকত, তাঁর ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করা আমাদের দুনিয়া আখিরাতে নাজাতের উসিলা।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র বিলাদাত ও ওফাতের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালে আমরা বেশি বেশি করে তাঁর শানে, তাঁর আহলে বায়ত ও সাহাবা কেরামের শানে দরুদ ও সালাম নিবেদন  করব।  আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলে মুহাম্মদ; কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলে ইবরাহিম; ইন্নাকা হামী দুম্মাজিদ...।  

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×