ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন

ড. মো. জামাল উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন

দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া আকস্মিক বন্যা

দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া আকস্মিক বন্যায় মানুষের ঘর-বাড়ি, মুরগির খামার, প্রাণিসম্পদ, বীজতলা ও ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো ও পরি-কাঠামো ক্ষতি হয়েছে অবর্ণনীয়ভাবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, এবারের বন্যা চলতি বছরে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন-সংশ্লিষ্ট চতুর্থ বড় দুর্যোগ।

এ দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগন বন্যার্থদের সাহায্যে যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা কল্পনাকেও হার মানায়। সে সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা।

জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন মতে, সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের ২৩ জেলায় ৩,৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং ১৪.১৪ লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী, আউশ, আমন ধান, শাকসবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন ফসলের উৎপাদন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে  আমন ধান (৪.১২ লাখ মেট্রিক টন) ও এর বীজতলা। এতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা থেকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ধান পাওয়া যেত। যা পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে। এর বাইরে প্রায় ১ লাখ সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন আউশ ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। সবমিলিয়ে ২ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। 
ক্ষতির তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে শাকসবজি। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদনের ১ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। উক্ত প্রতিবেদনমতে, ২০ কোটি টাকা মূল্যের আদা, ১১ কোটি টাকার হলুদ, ১৭ কোটি টাকার আখ, ৪০ কোটি টাকার পান, কলাসহ অন্যান্য ফলের ৩১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিসাবমতে, বন্যায় মাছ, মাছ চাষের অবকাঠামো এবং লাইভস্টক সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। শুধু কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী জেলায় চার হাজার পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এবারের বন্যায় কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার প্রতিবেদনমতে জানা যায়, কুমিল্লা জেলায় বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রোপা-আমন জমির পরিমাণ ২২ হাজার ২৯৩ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ৮৫.৬৭ শতাংশ। মোট ক্ষতিগ্রস্ত রোপা আমন বীজতলা জমির পরিমাণ ৩ হাজার ১৭৮ দশমিক ৫ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ৪৮.২৬ শতাংশ। খরিপ-২ শাকসবজির মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪১৩ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ৫২.৩৯ শতাংশ।

উক্ত প্রতিবেদন মতে, রোপা আউশ-এর মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ২২ হাজার ৯৩ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ২৭.৫৪ শতাংশ। বোনা আমনের মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৫৫৪ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ২.৮১ শতাংশ। আখ ফসলের মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৭৭ দশমিক ০৫ হেক্টর, যা মোট ফসলি জমির ১৬.৭৫ শতাংশ। উক্ত ক্ষতির মোট পরিমাণ টাকার হিসাবে ৭৫৫২০.৫৮ লাখ টাকা। 
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দৈনিক কুমিল্লার কাগজের সংবাদ মতে, কুমিল্লার বন্যায় কৃষিখাতে সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর জমি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এখনো পানির নিচে ডুবে আছে কুমিল্লার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মনহরগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ জমি।

স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন মতে, টানা বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে কুমিল্লার ১০০ কিলোমিটার সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফেনী জেলার প্রতিবেদন মতে, ফেনী জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৩৫৬৭৪ হেক্টর, যা মোট ফেসলি জমির ক্ষতির পরিমাণ ৯৩.৬৬ শতাংশ। উক্ত ক্ষতির পরিমাণ টাকার হিসাবে ৫২৪৪৮.০৭ লক্ষ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৬৬৭৯০টি।

গত ২৪ আগস্ট, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব বিভাগের সঙ্গে এক সভায়  কৃষি পূনর্বাসনের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ‘সারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। কৃষকদের সারের কোনো সংকট হবে না।’  সেখানে আরও বলা হয়, বন্যাদুর্গত এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যেখানে আমন উৎপাদন সম্ভব নয়, সেখানে শাক-সবজিসহ উপযোগী অন্যান্য ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুততম সময়ে আমনের বীজতলা তৈরি, বন্যা কবলিত এলাকার নিকটতম এলাকায় বীজতলা প্রস্তুত করা, মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণকে বন্যা উত্তর কৃষি পুনর্বাসনের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা, বন্যা কবলিত এলাকায় ব্লক এবং উপজেলাভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন উপদেষ্টা।  
কৃষিসচিব টিবিএসকে বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আমনের বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। যাতে করে আমনের যেসব জমির চাষ নষ্ট হয়েছে, সেখানে পুনরায় আমন রোপণ করা যায়।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষি পুনর্বাসন। ভয়াবহ এই বন্যার পর, কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন করে আমন চাষে।

এছাড়াও শাক-সবজিসহ অন্য জমিগুলোতেও চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য কাজ চলছে বলে জানান তিনি। বণিকবার্তার প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমান সরকার কৃষি পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা হিসেবে ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ৪০ লাখ ডলার সহায়তা বরাদ্দ করেছে বলে জানা যায়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমনের বীজতলা তৈরি ও আমন ধানের বীজ বপন করা হয়েছে, যা সহসাই উপযুক্ত জায়গায় আমনের চারা রোপণ করে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক (গবেষণা) ড. মুন্সী রাশীদ আহমদ বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পানি নেমে যাওয়ার পর যে এলাকায় যে ফসল উপযুক্ত, তা স্থানীয় চাহিদা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে আবাদ করা উচিত। যেসব জমিতে আমন ধান আবাদ করা সম্ভব হবে না, সেখানে সব্জি ও মসলা জাতীয় ফসল দেওয়া যেতে পারে।

তার জন্য বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতসমূহের চারা/ বীজ বিনামূল্যে বিতরনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলে কৃষকদের ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। জানা যায়, কুমিল্লা অঞ্চলের বন্যাপরবর্তী কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে চারা বিতরণের লক্ষ্যে সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা প্রায় ৪০/৫০ হাজার আগাম শীতকালীন বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, কুমিল্লার উপপরিচালক আয়উব মাহমুদ বলেন, আমনের বীজতলা ঠিক করার জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা হিসেবে কুমিল্লা জেলার জন্য ১৪৯ টন, বিএডিসি থেকে ১০৫ টন এবং সিনজেন্টা কোম্পানি থেকে বীজ সহায়তা হিসেবে ১৫ টন বীজ পাওয়া গেছে। সে সঙ্গে কৃষক তাদের নিজস্ব সংগ্রহে রাখা ৫-১০ টন ধানের বীজতলা তৈরির কাজ চলমান রেখেছে।

বন্যামুক্ত এলাকা থেকে আমন ধানের চারা সংগ্রহ করে রোপা আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কৃষকদের বিনামূল্যে চারা সরবরাহের লক্ষ্যে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নাবী জাতের আমন ধানের চারা উৎপাদন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকায় আমন ধান চাষ করা সম্ভব হবে না, সেখানে আগাম রবি শস্য বিশেষ করে সবজি, তেল ও ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 
ব্রি, গাজীপুর এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক ড. রফিকুল ইসলামের মতে, স্বল্পমেয়াদি আমন ধান, যেমন- বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৪৬ সহ অন্যান্য উপযুক্ত জাত এলাকাভেদে বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। এছাড়াও বিনা ধান-৭, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২২ জাতসমূহের উপযুক্ততা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়।

মাসকলাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। একইভাবে গিমা কলমি, ডাঁটা, পালং শাকসহ শীতকালীন আগাম সবজি  চাষ করা সম্ভব। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। ইতোমধ্যে বন্যাপরবর্তী করণীয় নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা অত্যান্ত বাস্তবসম্মত। বন্যার তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কৃষিবিভাগসমূহ বন্যাপরবর্তী করণীয় ঠিক করতে এসব পদক্ষেপসমূহ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। 
দেরিতে বপন উপযোগী জাতের আমন ধানের চারার সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা; সঠিক সময়ের মধ্যে আমন ধান রোপণ, আগাম শীতকালীর সবজি চাষ, বন্যাপরবর্তী সময়ে বসতবাড়ি এলাকায় সমন্বিত খামার পদ্ধতি গড়ে তোলা; কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে উৎসাহ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান; দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি; বন্যার আগাম সতর্কবার্তা জারি, শস্য-বীমা চালুকরণ, বেসরকারি বীজ কোম্পানি থেকে কৃষকদের মানসম্মত বীজ সহায়তা প্রদান; সারের মজুত ও সরবরাহ নিশ্চিত রাখা; ক্ষতিগ্রস্ত মুরগি খামারিদের লোন সুবিধা প্রদান, প্রাণিসম্পদের চিকিৎসার সুব্যবস্থাকরণ; বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার জন্য খাল, নালা দ্রুত সংস্কার জরুরি।

পানি চলাচলের রাস্তায় প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ; নিচু এলাকার জন্য জলাবদ্ধতা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার; কৃষিখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদারকরণের মধ্য দিয়ে বন্যাপরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

 

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা;
সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট
এফএও- জাতিসংঘ

[email protected]

×