.
গত ১৫ বছর ধরে গুম, হত্যা, অপহরণের শিকার এবং চাকরিচ্যুত হয়েছেন বাংলাদেশের জানা-অজানা অনেক সাংবাদিককর্মী। কিন্তু এসব হত্যাকান্ডের বিচারকার্য পরিচালনা করার তেমন নজির নেই। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের মতো ঝুলে আছে কতিপয় তদন্ত ও এর বিষয়বস্তু। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও কি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশ পেতে পারে না?
বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, যে কোনো সময়কার ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত হামলা-মামলা-নির্যাতন ও হত্যা প্রায় স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসাবে দেখা দিয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, বিগত দুই বছরের তুলনায় আরও দুই ধাপ নেমেছে বাংলাদেশ। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ২৭ দশমিক ৬৪ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৬৫তম। যেখানে ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩তম। স্কোর ছিল ৩৫ দশমিক ৩১।
গত ১৫ বছরে সাংবাদিক হত্যার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ২০২৩ সালে সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি, একাত্তর টিভি ও দৈনিক মানবজমিনের বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি নাদিম ১৪ জুন রাতে বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় হামলার শিকার হন।
পরদিন ১৫ জুন বিকেলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (বরখাস্তকৃত) ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবুসহ আরও কয়েকজন ওই সন্ত্রাসী হামলা করেছিল। এরপর ১৭ জুন এ ঘটনায় নিহত নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাধুরপাড়া ইউপির সাময়িক বরখাস্ত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলমকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। গত বছরের জুনে মাহমুদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পরও হয়নি ন্যায় বিচার। কারাগারে গত এক বছরে ৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। বুধবার (১০ জুলাই) জামিনে মুক্তি পেয়ে উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কেবি মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এলাকার মানুষের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি এমনটি দাবি করেছেন। নাদিম হত্যা মামলার আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘তার বক্তব্য শুনেই বোঝা যায় জেলখানায় রাজকীয়ভাবে ছিলেন। (সূত্র : সময় নিউজ, ১২ জুলাই, ২০২৪)
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এ পর্যন্ত কম পক্ষে ১১১ বার সময় বাড়িয়েছেন আদালত। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমে চার্জ গঠন ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। সামিট গ্রুপের স্বার্থ বিনষ্ট হবে এমন একটি জ্বালানি বিষয়ক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন রুনি। কিন্তু এটিএন বাংলায় প্রচারের আগেই তা আটকে দেয় চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান।
একাধিক সূত্র বলেছে, গত শেখ হাসিনার সরকার তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে দেয়নি। এই মামলার তদন্ত কাজ এখনও বন্ধ আছে।
এছাড়াও বিগত সালের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালের ৮ জুন সাতক্ষীরার পত্রদূত সম্পাদক শ.ম আলাউদ্দীন খুন হন। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল খুন হন। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান তার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। ২০০১ সালে খুলনার দৈনিক অনির্বাণের সাংবাদিক এসএম নহর আলী হত্যা, ২০০২ সালে খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চলের স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন হত্যার বিচার মেলেনি আজও।
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান ও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা। একই সালের ২ মার্চ কেরানীগঞ্জে দি নিউএজের সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পু নিহত হন, ২৭ জুন নিজের অফিসে নিহত হন খুলনার দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু, অক্টোবর মাসে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় নিহত হন। সর্বশেষ খুন হন দৈনিক সংগ্রামের খুলনা প্রতিনিধি বেলাল হোসেন। ২০০৫ সালের ২৯ মে কুমিল্লার দৈনিক মুক্তকণ্ঠের রিপোর্টার গোলাম মাহমুদ নিহত হন। ঠিকাদারি চক্রের বিরুদ্ধে লাগাতার রিপোর্ট করে একই সালের ৫ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রতিনিধি গৌতম দাস খুন হন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক। জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নূরুল ইসলাম ওরফে রানা খুন হন। আগস্ট মাসে গাজীপুরে সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারি খুন হন।
সর্বশেষ ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী। ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে খুন হন বরিশালের মূলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি পল্টনে নিজ বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন। ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়। ২০১১ সালে একই দিন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। এসব ঘটনা বেদনাদায়ক, খুবই নির্মম। এই হত্যাকা-গুলোর বিচার নিয়ে প্রহসন করা হয়েছে। বারবার তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পেছানো হয়েছে। ভুক্তভোগীর স্বজনরা পাননি ন্যায় বিচার।
চলতি বছরেই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে গত ৫ আগস্ট রাজনীতি ও ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবের নেতৃত্বে রয়েছেন। তাছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সড়ক পরিবহন শ্রমিক দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও সাংবাদিক হাসান মাহমুদকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। (বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট, ২৯ আগস্ট, ২০২৪)।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার ঘটনা একদিকে পুরো সাংবাদিক সমাজকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, অন্যদিকে জনগণের মনেও ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে, অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। যা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হামলাকারীরা ‘অদৃশ্য শক্তির’ প্রভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ার ঘটনাও সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানিকে ত্বরান্বিত করছে। তাই দেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে আজ আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায় না। সাংবাদিকতা খুব ঝুঁকিপূণ পেশা হলেও হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না হওয়া বর্তমান বাংলাদেশের কাম্য নয়। প্রতিটি ঘটনানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও তাদের ন্যায় ও নিরপেক্ষ কার্যবিধিকে সহায়তা করলে স্বচ্ছতার মানদন্ডে বিপ্লবমুখর বাংলাদেশ পাবে বৈধতা ও নায্যতা। দেশে অগণতান্ত্রিক চর্চা, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসার স্বাধীনতাকে দমন-পীড়ন কাম্য নয়।
লেখক : গবেষণাকর্মী