ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

দিন শেষে আমরা কি সুখী

ড. ইউসুফ খান 

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দিন শেষে আমরা কি সুখী

মানবজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো সুখ

মানবজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো সুখ। ঢেউ খেলানো দুঃখের সাগরে বসবাস করা মানুষের জীবনে একচিলতে সুখ এনে দিতে পারে জীবন ধাঁচের কল্পনাতীত পরিবর্তন। সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন। সব মানুষই সুখের পেছনে ছোটে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ বেড়েই চলছে।

তাহলে কোথায় গেলে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা সম্ভব হবে? কোথায় গেলে একটু সুখের দেখা মিলবে? এর ঠিকানাই বা কী? এ সব প্রশ্ন আদিকাল থেকে মানব মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুখের জন্য আমরা যতই হাঁসফাঁস করি না কেন, সুখ যেন এক সোনার হরিণ, দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। 

সুখের রং লাল, নীল, হলুদ, বেগুনিসহ আরও নাম না জানা কত রং। জীবনের উঁচু-নিচু পথ চলতে গিয়ে কত ধরনের বাহারি সুখ আসে আমাদের জীবনে। কিন্তু কষ্টের কোনো রং নেই, আছে শুধু প্রকারভেদ আর ধরন। বিভিন্ন ধরনের কষ্ট শামুকের মতো বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে। আর সময়ে অসময়ে ফনা তুলে। তবে চাপা কষ্টের তীব্রতাই যেন বেশি। 
মানুষ তার নিজের সুখকে যে ভাবে খুব সহজে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে, কষ্টগুলোকে কিন্তু অত সহজে শেয়ার করতে পারে না বা করতে চায় না। কষ্টগুলো একান্তই তার নিজের, যা বুক পকেটের গভীরতায় বসবাস করে। আর সেজন্যই হয়তো প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার লেখা বই নক্ষত্রের রাতে বলেছেন-
‘দুঃখের কথা কি আর বলিব/দুঃখ কারে বলে,/দুঃখ হলো বুকের আগুন,/দাউ দাউ করে জ্বলে।’ দুঃখ আছে বলেই তো মানুষ সুখের মূল্যায়ন করতে পারে। আর সুখ-দুঃখ মিলিয়েই তো মানব জীবন। 
পৃথিবীতে সবাই সুখী হতে চায়। অনেকে ভাবেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিই মানুষকে সুখী করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জরিপ থেকে জানা যায় যে, শুধু অর্থকড়ি ও প্রতিপত্তি আসলে মানুষকে সুখী করতে পারে না। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুখ বৈষয়িক বা জাগতিক কোনো ব্যাপার নয়, সুখ বহুলাংশে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সুখী হওয়ার অন্যতম একটি মূল মন্ত্র হচ্ছে, আশাবাদী হওয়া।

কোনোকিছু নেতিবাচক দেখলেই ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং ভাবতে হবে এ ধরনের খারাপ সময় চিরস্থায়ী নয়, পরিবর্তন আসবে। ইতিবাচক আবেগ স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মানুষকে সুখী রাখে। 
যদি ছোটবেলায় ফিরে যাই, তাহলে দেখিÑ যখন স্কুলে যেতাম, তখন মনে হতো পৃথিবীর সব সুখ যেন আমার। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলের পড়া তৈরি করা, ভাই বোনের সঙ্গে খুনসুটি। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। স্কুল পালানোর পাঁয়তারা। পকেটে সামান্য দু’একটি টাকা হলে বুক ফুলিয়ে বলা, ‘আজ সারাটা দিন আমার’। বন্ধুদের নিয়ে এটা সেটা কিনে খাওয়ার মজাটাই ছিল অন্যরকম।

বিশেষ করে  স্কুল পালানোর দুরন্তপনা ছিল অসাধারণ এক সুখকর স্মৃতি। তখন চাহিদা বলতে, বিকেল বেলা মাঠে গিয়ে খেলতে পারলেই হতো। প্রয়োজন ছিল না দামী শার্ট, দামী প্যান্ট, আধুনিকতার ছোঁয়াও গায়ে লাগেনি। আড্ডার মাঝেই যেন লুকিয়ে ছিল সব সুখ। ছিল না কে ধনী, কে গরিব- তার বৈষম্য। কার কোন ধর্ম, তা নিয়েও ছিল না কোনো মাথাব্যথা।

সত্যি বলতে কি, যেসব মানুষের জীবনে চাহিদা কম, যারা অল্পতেই তুষ্ট থাকে তারাই সবচেয়ে বেশি সুখের দেখা পায়। প্রকৃতপক্ষে সুখ সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তবে তা ছুঁয়ে দেখার কৌশল জানতে হবে। রবিঠাকুর বলেছেন, ‘তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও।’ অর্থাৎ সুখ কখনো নিজে নিজে হাতের কাছে এসে ধরা দেয় না। সুখের সন্ধান করতে হয়, অর্জন করতে হয়।
তবে সুখ-শান্তির ব্যাপারে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তি ওয়ারেন বাফেটের জীবন দর্শন ভিন্নরকম। তিনি মনে করেন, ধন দৌলত নয়, মনের সুখই আসল সুখ। ফেলে আসা দিনগুলো তার অত সহজ ছিল না। ছোট বেলায় চুইংগাম, কোকাকোলার বোতল এমন কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ম্যাগাজিনও বিক্রি করতেন। বলা যায় হকার থেকে বিশ্ব ধনী। এ বছরের আগস্ট মাসে তিনি ৯৪ বছরে পা রেখেছেন। এই ধনকুবের মনে করেন, তিনি এখন অতিরিক্ত ইনিংস খেলছেন। 
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা কি পেলাম আর কি পেলাম না, এসব হিসাব-নিকাশ না করে বিলিয়ে দেওয়াতেই যেন তাদের সুখ আর সার্থকতা খুঁজে পান। ওয়ারেন বাফেট তাদের অন্যতম। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে জনহিতৈষীদের একজন। এখন পর্যন্ত দান করেছেন ৫৬ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এ অনুদান নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘এ অর্থ সমাজের কাজে লাগুক, এটাই আমার একান্ত কাম্য।’

এত সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুবই মিতব্যয়ী ও সাদামাটা জীবন যাপন করেন। ওয়ারেন বাফেট এমন এক মানুষ যার কোনো শত্রু নেই বললেই চলে। ভালোবেসে তাকে ডাকা হয় ‘ওমাহার জাদুকর’। ফোর্বস পত্রিকার ২০২৪ তালিকা অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ এখন ১৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। 
৬৫ বছর ধরে যে বাড়িতে বসবাস করেন, সে বাড়িতে বসেই তিনি অনলাইন ব্রিজ খেলে অপরিসীম আনন্দ ও সুখ লাভ করে থাকেন। ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, তার এ দীর্ঘজীবনের রহস্য হলো সুখ। মানুষের দীর্ঘায়ুতে সুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ

×