ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা-অর্জন ও প্রত্যাশা

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা-অর্জন ও প্রত্যাশা

আলোকিত মানুষ তৈরি ও মনুষ্যত্ব গঠন হলো শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য

আলোকিত মানুষ তৈরি ও মনুষ্যত্ব গঠন হলো শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য, যারা সমস্ত সংকীর্ণতামুক্ত, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা পরিহার করে সমাজ-দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। উচ্চশিক্ষা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি দ্রুত বদলে দিচ্ছে। তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। তবে উচ্চশিক্ষা অনেকটা ব্যয়বহুল হওয়ায় এর অর্থায়নেও অনেক দেশকে বেশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীনতা উত্তর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু করলে বিগত ৫২ বছরে উচ্চশিক্ষার পরিধি বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ টিতে, যার মধ্যে ১৫২ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং এতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা (অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূতসহ) ৪৪,৭২,৮৩২ জন (যা সারণী-১ এ দেখানো হয়েছে)।

সারণী-১ : ২০২২ সালে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শ্রেণিবিন্যাস শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয়/অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর শতকরা হার স্বায়ত্তশাসিত/ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৩ ৩,১৪,১৩০ ৭.০২% জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২,২৬৮ ২৯,৭৫,৮৯৩ ৬৬.৫৩% ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ১,৩৩৬ ২,৬৫,০৯৮ ৫.৯৩% বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ০১ ৫,৮৯,০৬২ ১৩.১৭% বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৬ ৩,২৮,৬৪৯ ৭.৩৫% সর্বমোট ৪৪,৭২,৮৩ ১০০%।
উৎস : বার্ষিক প্রতিবেদন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
সারণী-১ এ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৭ ভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে অধ্যয়নরত; যদিও উক্ত কলেজসমূহে পঠন-পাঠন ও শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে। এতদসত্ত্বেও এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে কর্মমুখী-আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করা গেলে এসডিজি, ২০৩০ ও ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
এটা সত্য যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার গুণাগুণ, উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার। তাই যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম, পঠন-পাঠন ও গবেষণার সার্বজনীনতা আন্তর্জাতিক মানের হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, উচ্চশিক্ষার মান সুনিশ্চিত করতে হলে ইউনেস্কো সুপারিশ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দসহ শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক সংযোগ বৃদ্ধিসহ বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে নানামুখী তৎপরতা চালাতে হবে।

পাশাপাশি সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, শিক্ষা প্রশাসনে অভিজ্ঞ, শিক্ষকতা ও গবেষণায় সুখ্যাতি অর্জনকারী অধ্যাপককে যথাস্থানে পদায়ন করতে হবে। এতে টেক্সই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ (ঝউএং-৪) অনুযায়ী শিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হবে।
স্বাধীনতা উত্তর উচ্চশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ায় এর সম্প্রসারণও হয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে এটা সম্প্রসারণ নাকি বিস্ফোরণ তা সময়েই বলে দেবে। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবাসংস্থাগুলো পরিচালনার জন্য যোগ্য লোক না পাওয়ায় অনেকক্ষেত্রেই বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ চালাতে হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তারা বেকার হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে অশিক্ষিতের চেয়ে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশিÑশিক্ষিতের মধ্যে শতকরা ৯ ভাগ, আর অশিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ২.২ ভাগ বেকার। বর্তমানে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলিয়ে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে শিক্ষা যে একটি মৌলিক অধিকার তা উল্লেখ রয়েছে। এ লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। উপরন্তু উচ্চশিক্ষা প্রসারের জন্য বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা ও ১৯৭৩ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল যাতে বিশ^বিদ্যালয়সমূহ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতসহ শিক্ষকগণ চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার সুযোগ পায়।

এ সমস্ত কর্মকা-ের পাশাপাশি দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে সভাপতি ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। উক্ত কমিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের উপযোগী নাগরিক তৈরির জন্য যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন, কমিশনের উচিত সে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা সুপারিশ করা।’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চান, তার প্রতিফলন ঘটে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা অতীব জরুরি। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্যনতুন দিক নিয়ে গবেষণা করবে; পুরনো বিষয় নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করবে; প্রচলিত ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করবে ও নতুন উত্তর অন্বেষণ করবে।

অতঃপর সৃজনকৃত জ্ঞান ও পরিবর্তিত ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ এবং সমাজের কল্যাণে উক্ত গবেষণালদ্ধ ফলাফলকে ব্যবহার করে দেশের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে-এটাই স্বাভাবিক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা; প্রযুক্তি ও গবেষণার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব গিতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশ^বিদ্যালয়সমূহের গবেষণা খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারখানার সমস্যাদি নিয়ে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন সমস্যা বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে জানাবে। আর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তা গবেষণার মাধ্যমে সমাধান করে দেবেন। এর বিনিময়ে বিশ^বিদ্যালয় শিল্প প্রতিষ্ঠান কাছ থেকে গবেষণার জন্য অর্থ পাবে।

আর শিল্প প্রতিষ্ঠান তার সমস্যা সমাধানের মাধমে পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য আনয়ন করতে সক্ষম হবে। এতে বিশ^বিদ্যালয়গুলো অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে রাষ্ট্রের রাজস্ব বাজেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের বাজেট নিজেরাই প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে টিকে থাকতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষের জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

তাই বর্তমান বিশে^র চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের মৌলিক ও ফলিত গবেষণার দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণা সংস্কৃতি ও পরিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত একটি কৌশলগত গবেষণা কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।

উক্ত পরিকল্পনায় বছরে শিক্ষকদের অনুপাত অনুযায়ী কতগুলো গবেষণা পত্র দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইনডেক্স জার্নালে প্রকাশ হওয়া দরকার, কি কি ধরনের গবেষণা করা উচিত, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় কিভাবে যুক্ত করা হবে, গবেষণার ফলাফল সমাজের কল্যাণে কতটুকু ব্যবহৃত হচ্ছে, গবেষণাপত্র উন্নতমানের জার্নালে প্রকাশিত বা পেটেন্টযোগ্য হলে কি ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয় সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে।

মনে রাখতে হবে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশে^ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে বিশ^বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশ গঠনে আধুনিক-বিজ্ঞানমনষ্ক-কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন যা মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। উল্লেখ্য, উচ্চশিক্ষার কৌশলগত পরিকল্পনার সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বিশ^বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা, গবেষণার মান ও উৎকর্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।

উপরন্তু দেশের বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চমানের গবেষণার জন্য ‘সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’;, গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য ‘ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’; ও বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা হলে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংখ্যাগত উন্নয়ন বেশ চমৎকার হয়েছে সত্য; কিন্তু মানের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এতে বিশ^বিদ্যালয়গুলো যেমন জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হবে তেমনি আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ অনুযায়ী শিক্ষা ও গবেষণা মান বজায় রাখতে সক্ষম হব-ইনশাআল্লাহ।

লেখক : বিশিষ্ট কবি, সোলবি সদস্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সোলবি উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×