ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

পথভ্রষ্ট জাতির সংকট: কেন ও কীভাবে সমাধান সম্ভব

রহমান মৃধা

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পথভ্রষ্ট জাতির সংকট: কেন ও কীভাবে সমাধান সম্ভব

রহমান মৃধা

মানব সভ্যতার ইতিহাসে জাতির বিকাশ, পতন এবং পথভ্রষ্টতা সবসময়ই আলোচনার বিষয় ছিল। জাতির পথভ্রষ্টতা সাধারণত অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং নেতৃত্বের সংকটের ফলাফল। আজকের বিশ্ব এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতির পথভ্রষ্টতার সমস্যা পুনরায় চিহ্নিত করা এবং প্রতিকার করা অত্যন্ত জরুরি। অতীতে নেওয়া পদক্ষেপের শিক্ষা এবং বর্তমান বাস্তবতার আলোকে এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো যেমন- রোমান, মেসোপটেমিয়া, এবং মায়া সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল নৈতিক অবক্ষয়, অভ্যন্তরীণ কলহ, এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা। উদাহরণস্বরূপ, রোমান সাম্রাজ্য তার প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, একটি জাতি তখনই পথভ্রষ্ট হয় যখন তারা তাদের নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে এবং সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়।

ইসলামের স্বর্ণযুগে, খলিফারা যেমন হারুন আল-রাশিদ এবং আল-মামুন জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিচার ও ন্যায়বিচারের প্রতি যত্নবান ছিলেন। এ সময় মুসলিম সভ্যতা বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নেতৃত্বের দুর্বলতা, আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুতি এবং নিজেদের মধ্যেকার কলহের কারণে মুসলিম সভ্যতার পতন ঘটে। এই ঘটনাগুলো আমাদের শেখায়, জাতির উৎকর্ষ তখনই সম্ভব যখন তারা নৈতিকতা, শিক্ষা ও একতা বজায় রাখতে পারে।

উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো যেমন ব্রিটিশ, ফরাসি এবং পর্তুগিজরা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাতিকে শোষণ করেছে, যা তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ঐক্যের অভাবে সম্ভব হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে সমাজে নানা ধরনের অবক্ষয় দেখা দেয়। এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়, জাতির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান না থাকলে, তারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়তে পারে।

বর্তমান বিশ্বে জাতিগত সংঘাত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন সোমালিয়া এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক জাতিগত সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং দুর্নীতি জাতিকে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, জাতিগত ঐক্য এবং নৈতিক নেতৃত্বের অভাব একটি জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেরও বেশি সময় পরও জাতি তার উদ্দেশ্য ও দিকনির্দেশনা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। দুর্নীতি, শিক্ষার মানের অবনতি, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক কলহ দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে জনগণের আস্থা কমে গেছে। জাতীয় ঐক্য ও নৈতিকতার অভাবে দেশ একটি গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে যা তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার শিক্ষাব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা এবং শিক্ষকদের নৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতে হবে। বর্তমানের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য।

নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতিকে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজে নৈতিকতা প্রচার করতে হবে এবং মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় নেতারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার বার্তা পৌঁছানোর জন্য কার্যক্রম চালু করতে পারেন। এর মাধ্যমে সমাজের নৈতিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার সম্ভব।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট দূর করতে দেশে একটি শক্তিশালী, নৈতিক এবং কার্যকরী রাজনৈতিক সংস্কার দরকার। নেতৃত্বের যোগ্যতা ও নৈতিকতার উপর জোর দিয়ে একটি সুশাসিত ও ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে দেশে সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং জনগণের মধ্যে সংহতি ও ঐক্য বজায় রেখে জাতির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সচেতনতা ক্যাম্পেইন এবং সামাজিক আন্দোলন পরিচালনা করা যেতে পারে, যা জাতীয় সংহতি বাড়াবে এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করবে।

একটি জাতির পথভ্রষ্টতা তার ভবিষ্যতের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বর্তমানের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতিকে পুনরায় সঠিক পথে নিয়ে আসা সম্ভব। নৈতিকতা, শিক্ষা, নেতৃত্ব এবং ঐক্যের মাধ্যমে আমরা জাতিকে একটি সুষ্ঠু ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারি।

তাই যারা এখনও নৈতিকতার পথ থেকে বিচ্যুত, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের একটাই আহ্বান: “চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।” নৈতিকতার পথেই রয়েছে জাতির প্রকৃত মুক্তি ও উন্নতির চাবিকাঠি। আসুন, আমরা সবাই সেই পথেই এগিয়ে যাই।

লেখক: রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

 

এম হাসান

×