ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

মোহাম্মদ নাম যতই যপি ততই মধুর লাগে...

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোহাম্মদ নাম যতই যপি ততই মধুর লাগে...

প্রসঙ্গ ইসলাম

‘মোহাম্মদ নাম যতই যপি
ততই মধুর লাগে,
নামে এতো মধু থাকে
কে জানিত আগে........।’ (নজরুল)
মহান আল্লাহ তায়ালা প্রেরিত আখেরি পয়গাম্বর, তামাম নবীকুল শিরোমণি গোটা সৃষ্টিকুলের রহমত, অনুকরণ, ভক্তি ও শ্রদ্ধার মূর্ত প্রতীক আমাদের প্রিয় নবীজী রাসুলে কারীম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। তাঁকে যথাযথ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যেই আমাদের ঈমানের পূর্ণতা নিহিত। আর এ ঈমানের পূর্ণতা একজন মুসলমানের আমলে জিন্দেগীর সফলতা ও আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুলের পূর্বশর্ত।

খোদ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনি। অর্থাৎ, ওহে নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সা.)! আপনি জগৎবাসীকে বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ করো, তোমাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন...।’  রাসুল (সা.) নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন: কোনো মুমিন প্রকৃত মুমিন কখনো হতে পারবে না যতক্ষণ না সে আমাকে তার পিতা, সন্তান (এমনকি) গোটা মানবম-লী থেকে অধিক ভালোবাসবে।’ (তিরমিযী)।
আসলে যথোপযুক্ত ঈমান, ভক্তি, ভালোবাসা ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া পাওয়া। আমাদের সর্বাধিক ভালোবাসা থাকতে হবে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রতি। তারপর নিঃসন্দেহে আমাদের নবীজীর (সা.) প্রতি। নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’র (সা.) প্রতি ভালোবাসা, ঈমান ব্যতীত আল্লাহর প্রতি ভালবাসা অনর্থক। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানব জাতির মধ্যে হতে আবির্ভূত হলেও তার শান ও মর্যাদা অতুলনীয়।

আর তিনি এমন অপরূপ হৃদয় আর চরিত্র ধারণ করেছিলেন যে, তাকে এক নজরে দেখে যে কোনো মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ত, পাষাণ  মানুষের হৃদয় হতো বিগলিত, এমনকি পশু-পাখি ও গাছপালা পর্যন্ত তাঁর দর্শনের জন্য থাকত ব্যাকুল। পরবর্তীতে তাঁর ব্যক্তিত্ব ‘চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে’ তাঁর পূত জীবন চরিত পড়ে আপ্লুত হয়ে তাঁর আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে বিশ্বের অসংখ্য প-িত দার্শনিক।
ইসলামী শরীয়ত সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা। এখানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা.) প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। সর্বনি¤œ সীমারেখা তো আছেই। সর্বোর্ধ্বে রাসুলের ভালোবাসা যেন আল্লাহর ভালোবাসা ও মর্যাদা অতিক্রম না করে। কিন্তু এর মাঝখানে এক বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে নূরনবীকে (সা.) ভালোবাসার। এ ভালোবাসার সাগরে ভেসেছে রাসুলের পুণ্যাত্মা সাহাবীগণ (আল্লাহ তাঁদের সকলের ওপর তাই রাজি ও সন্তুষ্ট হয়েছেন)।
পরবর্তী যুগে প্রকাশ পেয়েছে অযুত কোটি নবীপ্রেমিক আশিকে সাদিক। আল্লাহতায়ালা তো কখনো নিজের সব সহায় সম্পদ ত্যাগ করে নিঃস্ব হতে বলেননি। কিন্তু হজরত আবু বকর (রা.) নবী প্রেমে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর সমুদয় সম্পদ, নিত্য ব্যবহার্য পারিবারিক-সাংসারিক দ্রব্যাদিও। এসব দেখে নবীজী (সা.) নিজেও আশ্চর্যান্বিত হন এবং বিচলিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন: আবু বকর! তোমার ঘরে আর কিছু রাখনি? বললেন: আল্লাহু ওয়া রাসূলুহু- আমার ঘরে এখন কেবল আল্লাহ ও তার রাসুলই..।’

এ ধরনের সীমার মধ্যে অসীম ভালোবাসার কারণেই আবু বকর (রা.) এ উম্মতের মধ্যে রাসুল (সা.) এর পর সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও সম্মানিত। বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্তও। সে যুগে রাসুল বন্দনার কারণে হজরত হাম্মান বিন সাবিত (রা.) ভূষিত হয়েছিলেন শায়িরুর রাসুল বা ‘রাসুলের (সা.) কবি’ হিসেবে। শুধু মানব জাতি কেন, তামাম কায়েনাত মাখলুকাত সৃষ্টিকুল নবীজীর স্মরণে হয়ে থাকে ধন্য।

ইশকে আল্লাহ ইশকে নবী, ইশকে কাবা মদীনা  বাংলাভাষী প্রতিটি হৃদয়তন্ত্রে উতলে দেনেওয়ালা কবি নজরুল (যাকে এক সময় এক শ্রেণির আলিম-ওলামা কাফির বলতেন) বুলবুলি পাখির কণ্ঠে সুমধুর সুর প্রকাশ হওয়ার রহস্য খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চয় বুলবুলি নবীজীর ‘মুহাম্মদ’ নামের দরুদ জপেই সুকণ্ঠী হয়েছে।
তার ভাষায়:
‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি 
বুলবুলি তুই আগে 
তাই কিরে
তোর কণ্ঠেরই গান
এতোই মধুর লাগে...।’
এ বিশ্লেষণ তার কবিত্বের চোখে, তার প্রেমিক দর্শনের। তার এ অভিব্যক্তি আমি শরিয়ত বলব না, তবে ইবাদত ও নিখাদ নবীপ্রেমের বা সাওয়াবের মাধ্যম বলতে আমার দ্বিধা নেই। ইসলাম কখনো হিকমত বা বুদ্ধিভিত্তিক প্রচার, মাওয়ায়িজ- উত্তম আলোচনা ও উপমার মাধ্যমে আকৃষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করেনি।

বস্তুতপক্ষে একজন প্রকৃত মুসলমান যখন সারাদিন শিরক করে না, মুনাফেকী করে না, জঘন্য বিদআতে লিপ্ত হয় না, তখন সে যেসব সুচিন্তা লালন করে সুস্থ ও শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে, সবই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেমন- হাদিস শরীফে আছে, কেউ যদি ইশা’র জামাত পড়ে ঘুমায়, সে অর্ধরাত ইবাদতের সাওয়াব পায়। আর যখন পরবর্তী ফজরের জামাতেও শামিল হয়, তাহলে পুরো রাতের নফল ইবাদতের সাওয়াব পায়, (তিরমিযী)।

সুতরাং যদি শিরক জাতীয় কিছু না থাকে, উপরন্তু যেখানে থাকে আল্লাহর স্মরণ নবীজীর (সা.) দরুদের আয়োজন, তা নিঃসন্দেহে ইবাদত। এদিক দিয়ে মিলাদ শরীফ, দরুদ শরীফের মাহফিল একটি উত্তম নফল ইবাদত। এসব অনুষ্ঠানে কী করা হয়? এতে আমরা হাদিসে বর্ণিত দোয়া সমূহ পড়ি, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করি, প্রয়োজন ও সময় অনুপাতে বিভিন্ন বরকতপূর্ণ আয়াত ও সূরাসমূহ তিলাওয়াত ও বিশ্লেষণ করি, ময়-মুরব্বীদের জীবন স্মরণ করে আখিরাত সম্পর্কে শিক্ষা হাসিলের চেষ্টা চালাই, হজরত রাসুলে কারীম (সা.) এর শানে ভক্তির সঙ্গে সালাতো সালাম নিবেদন করি, আখের আঞ্জাম দু’হাত তুলে পরওয়ার দিগার রাব্বুল আলামিনের দরবারে কুরআনের বর্ণিত আয়াত, হাদিসে বর্ণিত দোয়া ও  পুণ্যাত্মা বুজর্গদের শেখানো তরিকায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোনাজাত করি। এখানে কোন্ বিষয়টি সাওয়াবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়? 
আল্লাহপাক আমাদেরকে মহানবীর স্মরণ ও বরণের মাস তাঁর পয়দায়েশ ওফাতের মাস রবিউল আউয়ালে বেশি বেশি করে নবীজীর (সা.) জীবন চর্চা করব, হাদিস অধ্যয়ন করব, তাঁর সুন্নাহর আমলের ওপর গুরুত্ব দেব। তাঁর পবিত্র বংশধারাকে স্মরণ করব। নবীজীর জন্ম ও তিরোধানের পূণ্য স্মৃতিধন্য এ মাসে মহানবীর ওপর ওয়াজ আলোচনার পাশাপাশি চতুর্দিক থেকে ভেসে আসে ক্বিরাত, হামদ, নাতে রাসুল, গজল, কবিতা কাসীদা, নানা ভাষায় তারানা। এসবেরও গুরুত্ব অনেক।

আমরা যদি আমাদের সন্তানদের এসব সুর দিয়ে জবান ব্যস্ত রাখতে পারি, আগামীতে হয়তো তারা আর অশ্লীল গান বাজনার দিকে মনোযোগী হবে না। ইসলামী মাস ও দিবসগুলো পালনের মধ্যে এমন অনেক জরুরি রহস্য নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের সর্বক্ষণ ইসলামী সৌন্দর্যে অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×