সম্পাদকীয়
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফেরেনি জনপ্রশাসনে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই ব্যস্ত পদ-পদবি ও পদায়ন নিয়ে। অনেকেই ব্যতিব্যস্ত চেষ্টা-তদবির করে পদায়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে যেতে। আবার অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হতে।
এর জন্য প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন তারা। গত দুদিন উপসচিব পদমর্যাদার ৫০-৬০ কর্মকর্তা, যারা এবারে ডিসি হতে পারেননি, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনু বিভাগ (এপিডি) শাখায় গিয়ে হৈচৈ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। একপর্যায়ে তাদের ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখা যায়। বিষয়টি নজিরবিহীন। দুজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে লাঞ্ছনার খবরও আছে।
যা সচিবালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কাক্সিক্ষত নয়। জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার গত ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে সাবেক সরকারের একটানা শাসনামলে প্রায় সর্বত্র ব্যাপক দলীয়করণ, মেধা ও যোগ্যতা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন ও নিয়োগ, সর্বোপরি স্বজনপ্রীতির কারণে প্রশাসনে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সময় দিতে হবে।
উল্লেখ্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দু’দিনে দু’দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগ দিয়েছে নতুন করে। এ সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে এবং ডিসি পদে নিয়োগ পেতে গত দুদিন সচিবালয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত এবং ডিসি পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী কর্মকর্তারা। বঞ্চিতদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার যাদের জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দিয়েছে, তারা সাবেক পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ও আশীর্বাদপুষ্ট।
বিগত সরকারের আমলেও তারা ভালো পদে ছিলেন। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ডিসিদের প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানান তারা। একপর্যায়ে তারা দুজন যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার রুমে গিয়ে হৈ-হট্টগোল করেন। পরে বঞ্চিত কর্মকর্তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বঞ্চিত কর্মকর্তারা পরে গণমাধ্যমকে জানান, ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া প্রজ্ঞাপন দুটি বাতিলের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। যে কারণে সদ্য পদায়নকৃত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নির্ধারিত ব্রিফিং স্থগিত করা হয়েছে। নিয়োগকৃত ডিসিদের তালিকা থেকে ৮ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চার ডিসির জেলা পরিবর্তন করা হয়। সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য গঠন করা হয়েছে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি।
দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র পরিণত হয় গোষ্ঠীতন্ত্রে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে ফেলে। আমাদের দেশে আমলাদের তেমন রূপই আমরা বারবার দেখেছি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। জনসেবা, জনকল্যাণ, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করাই যাদের কাজ হওয়া উচিত, তাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করা চাই। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন দক্ষ আমলাতন্ত্র।
কোনো তোষণনীতির কাছে মাথা নত না করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ জায়গা থেকে সকল স্তরে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী আমলাদের যথোপযুক্ত স্থানে বসিয়ে কঠোরতা, পেশাদারিত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি জনবান্ধব ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড থাকতে হবে। দাবি নিয়ে দলগত বিক্ষোভের কোনো সুযোগ নেই।