ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

অভিমত

লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ খাতের বাস্তবতা

হারুন অর রশিদ

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ খাতের বাস্তবতা

বিগত ৫৩ বছরে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারা

বিগত ৫৩ বছরে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারা বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক ও দুঃখজনক বাস্তবতা। এটি একটি জাতির জন্য অপূর্ণ অগ্রগতি এবং পরিকল্পনার স্বল্পতার উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে এখনো সেই কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করা যায়নি। এই অবস্থা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক সমৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের জীবনের গুণগতমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা দীর্ঘদিনের। যদিও বিভিন্ন সময় নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মধ্যে বড় ফাঁক ছিল। বর্তমানে দেশের ৯৯ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কথা বলা হলেও, অনেক অঞ্চল এখনো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিতরণের মাঝে ব্যালান্স বজায় রাখতে না পারা। কয়লা, গ্যাস ও তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আগ্রহ এবং প্রয়োগের স্বল্পতা রয়েছে।

বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি উৎপাদন। ফলে, লোডশেডিং, বিদ্যুৎ বিপর্যয় এবং এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প খাতেও এর প্রভাব বিশাল। কারণ, বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং দেশের রপ্তানি সক্ষমতায় প্রভাব পড়ে। তাছাড়াও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো- প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।

বিদ্যুৎ খাতকে অনেক সময়ই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দায়িত্বহীনতার কারণে দেশের বিদ্যুৎ খাতে স্থিতিশীল উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ খাতের পুনর্গঠন এবং পরিকল্পনা আরও সমন্বয়ক ও সুসংহত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা বাঞ্ছনীয়। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় আরও বেশি মনোযোগ এবং বিনিয়োগ করতে হবে। সরকার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এই প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ যেমন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে, তেমনই পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
তাছাড়াও দেশে প্রাপ্ত গ্যাস-কয়লা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনতে হলে সিস্টেম আপগ্রেড এবং নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ চুরির মতো সমস্যাগুলো কঠোরভাবে মোকাবিলা করা উচিত।
বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বাংলাদেশকেও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং প্রকৌশলীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকারি নীতিমালায় দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ খাতের আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। 
সত্যিকার অর্থে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারকে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু উৎপাদনই নয়, পরিবহন এবং বিতরণ ব্যবস্থাতেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে হবে। বিদ্যুতের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমানোর জন্য আমাদের আরও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সুদৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।

নতুন প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে বিদ্যুৎ খাতকে সুশাসিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করাও জরুরি।

×