ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

রাজস্ব বাড়াতে স্বাধীন কর কমিশন

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজস্ব বাড়াতে স্বাধীন কর কমিশন

রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। এই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। তবে এই লক্ষ্যের বিপরীতে সংস্থাটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতিটা যথারীতি বড় অঙ্কেরই থাকছে।

গত এক দশকে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরাফেরা করছে। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে এটি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০২৯ অর্থবছরে ১০ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হবে। বাংলাদেশের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ঋণ-জিডিপির অনুপাত বেশি হলেও তাদের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বেশি।
প্রতিবেশী ভারতে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০২৪ অর্থবছরে দাঁড়াবে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ অর্থবছরে দেশটির রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ছিল ২০ দশমিক ২ শতাংশ। আমাদের দেশে বর্তমানে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হবে। অর্থনীতির যেখানেই সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, তাকেই করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত থাকা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এই হার সবচেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত  সোমালিয়া বা ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষে হওয়ার আর মাত্র এক বছরের কিছুটা বেশি সময় বাকি আছে। কিন্তু আমরা পেছনের কাতার থেকে মোটেও এগোতে পারিনি। 
বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো শোচনীয় নয়। তবে আমাদের বহুমুখী ঋণদান সংস্থার চাপ মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ যে বাড়াতে হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন অর্থায়নের জন্যও এর বিকল্প নেই। স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আদায়ের পথে তাই আনতে হবে অপরাপর দেশের অভিজ্ঞতার অভিনবত্ব। কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়ে যেতে হবে আয়বর্ধিষ্ণু এলাকাগুলোর কাছাকাছি। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনতেও শক্ত পদক্ষেপ কাম্য।
বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল দেবে না। ইতোমধ্যে গৃহীত রিরা (রিফর্মিং ইন্টারনাল রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং ট্যাক্টস (ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অ্যান্ড ট্যাক্স পেয়ারস সার্ভিসেস) প্রকল্পগুলো বেশ কাজ দিয়েছে। এ ধরনের আরও উপকারী প্রকল্প গ্রহণে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা মিলতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের জিডিপি অনুপাতে কর ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে গড়ে অতিরিক্ত ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ বাড়তি রাজস্ব বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে।

২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম-এক্সপেনডিচার সার্ভে অনুসারে, দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ ধনীর হাতে আর মোট ৩০ শতাংশ সম্পদ ওপরের নি¤œস্তরের হাতে। তাদের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করতে পারলে এর চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব বাড়বে। আয়বৈষম্যও কমে আসবে। জিনি কোইফিশিয়েন্টের (আয়বৈষম্য নির্ধারণের পদ্ধতি) হিসেবে দেশে বৈষম্য ১৯৯০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩৫।

তা এখন শূন্য দশমিক ৪৯-এ এসে গেছে। অর্থাৎ আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আসছে। দেশের দারিদ্র্য হয়তো সুনির্দিষ্ট হারে কমেছে, কিন্তু অর্থনীতির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্ব আদায় বাড়েনি।
আমাদের কর-ডিজিপির হার বাড়াতে হলে কর ফাঁকি দেওয়া ঠেকাতে হবে। অন্যদিকে, আবার আইএমএফের কথা মতো সেচের পানি, ডিজেল ইত্যাদির ওপর হরদম কর বাড়ানো যাবে না। তবে এটাও হয়তো ঠিক, অনেক দিন ধরে চলে আসা, এমনকি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কিছু একপেশে ও ব্যক্তিগত অনুরোধÑউপরোধে চলে আসা কর-রেয়াত বা অব্যাহতির বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।

সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। আইএমএফের চিরাচরিত তিনটি নীতি আছেÑ প্রথমত, নমনীয় বিনিময় হার, দ্বিতীয়ত, নমনীয় ও উচ্চ সুদহার এবং তৃতীয়ত, কঠোর মুদ্রানীতি। এরা অনেকটা আপ্তবাক্যের মতো তিনটি নীতি অনুসরণ করতে বলে থাকে বলে অভিযোগও রয়েছে।
তিনটিই অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত অদৃশ্য হাত (ইনভিজিবল হ্যান্ড)Ñ যেন সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বাইরেও অনেক বিষয় আছে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দেশকে গৎবাঁধা নীতির বাইরেও যেতে হবে। সে জন্য অতীতের মতো রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠনের কথাও ভাবা যেতে পারে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে, নাকি পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করা হবে, এ বিষয়ে অনেক আলোচনা আছে।

এদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে আমদানি শুল্কও কমবে। এতে আমাদের আমদানি রাজস্বও কমবে। এর প্রভাব পড়বে শিল্পোৎপাদনেও। অর্থাৎ হঠাৎ মুদ্রানীতির মাধ্যমে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। 
অন্যদিকে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ব্যাংকাররা তাদের ঋণ দিতে চান না কিংবা ঋণ না দেওয়ার জন্য নানা বাহানা  তৈরি করেন। বড় ব্যবসায়ীদের ওপর অবশ্য এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পান, কারণ তারা হয়তো তথাকথিত জামানত দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর বেশি মনোনিবেশ করতে হবে।

বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে হবে। সে জন্য হয়তো মাঝেমধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে যেন ঋণ পৌঁছায়, সে জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ নজর রাখতে হবে। 
আমাদের দেশে কোনো বছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয় না। এর পেছনে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কারণগুলো হলোÑ উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা, কর পরিসর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জরিপ কার্যক্রমে পদ্ধতিগত সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রতা, আন্তকর ব্যবস্থাপনায় তথ্য বিনিময়ের অপ্রতুলতা, দক্ষ জনবলের স্বল্পতা এবং ভৌত অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব।

প্রতিবছর বাজেটে রাজস্ব আদায়ের একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না এনবিআর। তখন লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানো হয়। সেটাও আদায় করতে পারে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কারণ, অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা, রাজস্ব ফাঁকি, সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম আর দুর্নীতি, রাজস্ব বোর্ডে লোকবলের স্বল্পতাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।

আরও রয়েছে জবাবদিহির অভাব। এমতাবস্থায় একটি স্বাধীন কর কমিশন গঠন করা জরুরি বলে মনে করি। এ বিষয়ে আগেও লিখেছিলাম। কিন্তু বিগত সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেবে বলে প্রত্যাশা করছি।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার, আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল 
এফএফ ফাউন্ডেশন

×