সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ-ভারত সুবিস্তৃত সীমান্তে সংঘটিত হত্যাকা- থামছে না কিছুতেই। সর্বশেষ, রবিবার দিবাগত রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৫ বছর বয়সী কিশোর জয়ন্ত কুমার সিংহ নিহত হন। গুলিতে আহত হন নিহত কিশোরের বাবা উপজেলার বেলপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব কুমার সিংহ এবং নিটালডোবা গ্রামের দরবার আলী।
বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ধনতলা সীমান্তে এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমর কুমার চট্টোপাধ্যায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সেদিন রাতে একদল ব্যক্তি দালালের সহযোগিতায় ধনতলা সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফের ডিঙ্গাপাড়া ফাঁড়ির সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে কিশোর জয়ন্ত ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার লাশও নিয়ে গেছেন বিএসএফ সদস্যরা। ভারতের অভ্যন্তরে ১৬ জন বাংলাদেশী আটক রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, এর আগে ১ সেপ্টেম্বর রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার লালারচক সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান ১৪ বছর বয়সী কিশোরী স্বর্ণা দাস। স্বর্ণা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশসহ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর এক প্রতিক্রিয়ায় এর তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে প্রতিবাদপত্র পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে সীমান্তে দুই হত্যকা-ের বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের পথে অন্তরায়। কেননা, সীমান্তে একটি মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেলে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ে বাংলাদেশেÑ যা আমরা কখনোই চাই না।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বছরের পর বছর সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করলেও এর প্রকৃত কোনো সমাধান হচ্ছে না। সীমান্তে চোরাচালান নৈমিত্তিক ঘটনা এবং এর সঙ্গে উভয় দেশের নাগরিকই জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকরাই কেন বারবার হত্যাকা-ের শিকার হয়, এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়াটা দুঃখজনক। বাংলাদেশীরা বেশিরভাগই নিহত হন বিএসএফের হাতে।
কিছু হয়েছেন ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারাও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুচ্ছ কারণে হত্যা করা হচ্ছে বাংলাদেশীদের। বিপরীত দিক থেকে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী তথা বিজিবি কোনো ভারতীয় নাগরিককে হত্যা বা নির্যাতন করেছে, এমন ঘটনা শোনা যায় না। বরং অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে থাকে বিজিবি।
সীমান্তে হত্যা বন্ধে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠকসহ প্রয়োজনে ভারতে গিয়ে তদন্ত কাজে যুক্ত হতে পারার বিধানও গৃহীত হয়েছে। তবু সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে না। বিএসএফ প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে সিদ্ধান্ত রয়েছে। তারপরও বন্ধ হয়নি হত্যাকা-। ফেলানী হত্যা তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। ভারতীয় আদালতে হত্যার বিচারের রায়ে ফেলানী পরিবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
সীমান্ত রক্ষা ও অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অধিকার অবশ্যই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর রয়েছে। কিন্তু নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা হবে কেন- এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না। যেখানে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, মানুষ পাচার এবং চোরাচালান বন্ধে যৌথ উদ্যোগ এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা ও আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে দু’দেশ কাজ করছে, সেখানে এসব হত্যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। সীমান্তে যে কোনো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বজায় রেখে সীমান্ত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করা হোক- এটা সবারই প্রত্যাশা।