ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

রোহিঙ্গা সংকট ও ভূরাজনীতি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকট ও ভূরাজনীতি

বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত দিয়ে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। মিয়ানমারের বন্দর শহর মংডুতে বিদ্রোহী ও জান্তা বাহিনীর লড়াই তীব্র হওয়ায় রোহিঙ্গারা সীমান্তের এপারে চলে আসছে। গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর এ দুই দিনেই ৭০০ থেকে ৮০০ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

আগস্টের আন্দোলনের সময়টার সুযোগ নিয়ে অন্তত আট হাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের মংডুর মনিপাড়া, সিকদারপাড়া ও আইরপাড়া এলাকায় অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদ থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

তাছাড়া উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দুই রোহিঙ্গা গ্রুপের গোলাগুলিতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। সরকারি তথ্য মতে, এই মুহূর্তে ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি আঞ্চলিক সংকটের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এতে করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তায় এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। প্রতিবেশী বড় দুই দেশ ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে দেশটি।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করেছে। তবে এ সমস্যা একদিনের নয়। এর বিভিন্ন জটিল দিক রয়েছে। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ দেশটির ক্ষমতার প্রধান অংশীদার সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর রয়েছে বহুমুখী প্রতিযোগিতা ও স্বার্থ। এছাড়াও ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন, ধর্মীয় নিধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ এ সংকটের বিভিন্ন প্রবণতা তৈরি করেছে।

এই বছরের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে।  বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিচ্ছে। এ সংকট দীর্ঘায়িত হতে থাকলে উপমহাদেশসহ বৈশি^ক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। 
মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারে ব্যাপক পরিসরে বিনিয়োগ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রধান অন্তরায়, যা সংকটকে দীর্ঘায়িত করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি কোনো দেশের সমর্থন না থাকলেও এশিয়ার অন্যতম দুটি শক্তিধর রাষ্ট্র এবং মিয়ানমারের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ব্যাপক ও বিস্তৃত।

ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের নিকট মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ২০১৩ সালে চীনের বিশ^ব্যাপী নতুন ভূকৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের তীর অঞ্চল রাখাইন (পূর্বের আরাকান) বিশে^র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি।

দেশটির প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, এর পরিমাণ আনুমানিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা সব পশ্চিমা দেশের মোট বিনিয়োগের দ্বিগুণের বেশি। যদিও মিয়ানমারে চীনের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ কৌশলগত কারণে খুব গোপন। শুধু গোলযোগপূর্ণ রাখাইনের সিতওয়ে শহরের ‘শয়ে’ গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস সঞ্চালন (শয়ে থেকে কুনমিং হয়ে চীনের গোঞ্জেহ প্রদেশ) পাইপ লাইন নির্মাণ ও তার নিরাপত্তার জন্য সেনানিবাস তৈরি ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প তৈরিতে বিনিয়োগ করেছে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার; যার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন স্বয়ং মিয়ানমারের সেনাপ্রধান।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, চীন শুধু রাখাইনেই সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রকল্প চালু রেখেছে।
চীনের অন্যতম শত্রুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের স্থলসীমান্ত সংযোগ রয়েছে। রাখাইন রাজ্য ভারতের জন্য ভূকৌশলগত স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারে ভারতের প্রভাব হ্রাস, ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলা এবং যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারকে হাতে রাখা চীনের অন্যতম সামরিক কৌশল।

রাখাইনের আকিয়াব সমুদ্রবন্দরে চীনের জ¦ালানি তেলের টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে; যার প্রকৃত উদ্দেশ্য তেল আমদানিতে মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের সামরিক শক্তির আধিপত্যকে জানান দেওয়া। এজন্য চীন মিয়ানমারের নিকট থেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া। চীন অবরোধের চার দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিকট সব ধরনের অস্ত্রের প্রায় একক বিক্রেতা।

চীনের নির্মিত অস্ত্রই মিয়ানমার প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান শক্তি। মিয়ানমারের সামরিক বাজারের ৯০ শতাংশই হচ্ছে চীনের দখলে। অস্ত্র উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, অস্ত্র প্রযুক্তি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুইডেনভিত্তিক ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট’-এর একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কেবল চীনের নিকট থেকে ১৬৯ কোটি ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছে মিয়ানমার।

সুতরাং এত বড় অস্ত্রের বাজার চীন কখনোই হাতছাড়া করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চীনের বিরুদ্ধে এর সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের কাচিন, সান, কোকাং অঞ্চলসহ কয়েকটি রাজ্য ও এলাকায় স্বাধীনতাকামীদের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারকে বশে রাখতেই চীন এমন দ্বিমুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কাজেই মিয়ানমারের নিরাপত্তার জন্য চীনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি চীনও তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারকে কৌশলে সর্বক্ষণ ছায়া দিয়ে চলেছে। 
ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ভারতও মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, করিডর সুবিধা, ট্রান্সশিপমেন্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা হলেও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনরত তিনটি রাজ্য মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের বিদ্রোহ দমন করতে মিয়ানমারের সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন না করে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ালে এ তিনটি রাজ্যের আন্দোলন দমন করা কঠিন হয়ে পড়বে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনরত সাতটি রাজ্য ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ পণ্য পরিবহন, সামরিক সরঞ্জামাদি প্রেরণ ও সড়ক যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথ ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডর। মাত্র ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই করিডরটি কৌশলগত কারণে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ চীন-ভারত যুদ্ধ হলেই এই করিডরটি দখল করে নিতে চীন চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন ট্রানজিটও যদি ব্যবহার করতে না পারে তবে ভারতের পক্ষে সেভেন সিস্টার্সের নিয়ন্ত্রণ হারানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বিকল্প হিসেবে ভারত মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে কালাদান নদী ব্যবহার করে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের মধ্য দিয়ে লম্বা একটি ‘মাল্টিমোডাল’ বা বহুমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট নামে পরিচিত।

ভারতের সার্বভৌমত্ব হুমকি মোকাবিলায় হাতে নেওয়া এই প্রকল্পে ভারত এরই মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এই প্রকল্পে কলকাতার হালদিয়া বন্দরের বিভিন্ন পণ্য সরাসরি সিতওয়ে বন্দরের মাধ্যমে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে পৌঁছানো সম্ভব। অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে সিতওয়ের কাছে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গঠনের প্রকল্প নিয়েও ভারত এগিয়ে গেছে। 
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন উত্তর রাখাইন যেহেতু ভারতের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে যে কোনো বিশৃঙ্খলা ভারতের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় কৌশলগত কারণেই ভারত মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করেন যে, চীন ভারতকে ঘিরে ফেলেছে।

তাই নিরাপত্তা ও সামরিক কৌশলগত কারণে মিয়ানমারে চীনের আধিপত্য কমাতে ভারত তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ‘অ্যাক্ট ইস্ট প্রকল্প’-এর আওতায় ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড যোগোযোগ স্থাপনের কাজও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তাছাড়া ভারত কিছু সমরাস্ত্র তৈরি করেছে। অস্ত্র বিক্রির বাজারের খোঁজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, সেনা-নৌবাহিনীর প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সফর করেছেন।

এই দুটি দেশ বেশ কয়েকটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত ২০০৫ সালে মিয়ানমারের নিকট প্রথমবারের মতো অস্ত্র বিক্রি করেছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার মুখে মিয়ানমারের নিকট ভারতের অস্ত্র বিক্রির খবর জানাজানি হলে বেশ কয়েকটি দেশ ও সংগঠনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক হুমকির মুখে পতিত হয়েছিল। ভারত শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নেয় যে, অস্ত্র বিক্রি নয় বরং ভারত-মিয়ানমার অভিন্ন সীমান্তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিরক্ষাবিষয়ক চুক্তিতে আবদ্ধ আছে।
রাখাইনে চীন-ভারত ছাড়াও জাপান মিয়ানমারের ৫ম বৃহৎ লগ্নিকারী দেশ। মিয়ানমারে চীনের যে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব রয়েছে, জাপানও আউং সান সুচির সময়ে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনভার গ্রহণের পর দেশকে সোভিয়েত যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই রাশিয়া মিয়ানমারমুখী হয়েছে।

মিয়ানমারের উচ্চশিক্ষার বাজার ধরতে এবং কৌশলে প্রভাব বিস্তার করার নীতি হিসেবে মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাশিয়া বিশেষভাবে অবদান রাখছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৭০৫ শিক্ষার্থী রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করেছেন; যাদের ৭০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছেন কেবল পারমাণবিক বিদ্যায়।

তাছাড়া রাশিয়ার সরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে গেলে রাশিয়া দেশটিতে বিনিয়োগ ও অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওই বছরই ৩০ বছর যাবত মিয়ানমারের অস্ত্র বাজারে চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া ভাগ বসায়। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, নব প্রযুক্তি ও প্রজন্মের অস্ত্রভা-ার সমৃদ্ধকরণ এবং বিমানবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমাতে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়াসহ বহুবিধ কারণেই মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেয়। 
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট’-এর গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কেবল রাশিয়ার নিকট থেকে মিয়ানমার কমপক্ষে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে। অর্থের হিসেবে রাশিয়া মিয়ানমারের দ্বিতীয় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। এ অবস্থানটি একচেটিয়া করতেই রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে।

রাশিয়া শুধু মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারের দিকেই নজর দিয়েছে এমন নয়, বরং বিনিয়োগে অর্থ সহায়তা এবং প্রযুক্তি রপ্তানির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাশিয়া মিয়ানমারের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চুক্তি করে ২০১৩ সালে, যার কাজ এরই মধ্যে চলছে। এছাড়া দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদ বিশেষ করে তেল ও গ্যাস আহরণে রাশিয়া এরই মধ্যে মিয়ানমারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।

মিয়ানমারের তেল-গ্যাসের ভা-ারের মুনাফায় নিজের আধিপত্য রাখতে রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’ রাজধানী ইয়াঙ্গুনে একটি অফিসও খুলেছে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার প্রতিযোগিতায় রাশিয়া কিছুতেই পিছিয়ে পড়তে চাইবে না। 
একদিকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী জোটের শক্তির মহড়া, অন্যদিকে রাখাইনে পরিবর্তিত ভূকৌশলগত গুরুত্ব প্রভৃতি কারণে রোহিঙ্গারা এখন আন্তর্জাতিক ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জান্তাবিরোধীদের রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ, রাখাইনে নতুন করে সংঘাত এবং বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকট মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য পুরো পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

একই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইনকে ঘিরে ভূ-রাজনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকায় মিয়ানমারের সঙ্গে সংকট সমাধান বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেও সামনে এসেছে। রাখাইনে চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের যেখানে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য সেখানে অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×