ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১

প্লাস্টিক থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক

মো. সম্রাট হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্লাস্টিক থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক

প্লাস্টিক আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের ইতিহাস অত্যন্ত আকর্ষণীয়

প্লাস্টিক আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের ইতিহাস অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময়। এটি ১৯শ’ শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাথমিকভাবে ১৮৩৯ সালে চার্লস গুডইয়ার রাবারের সঙ্গে সালফার মিশিয়ে প্রাকৃতিক প্লাস্টিক- ভালক্যানাইজড রাবার তৈরি করেন, ফলে রাবারের স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসইতা বৃদ্ধি পায়। ১৮৬২ সালে আলেকজান্ডার পার্কস সেলুলোজ থেকে পার্কেসাইন তৈরি করেন, যা প্রথম মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলি হোয়াট সেলুলয়েড আবিষ্কার করেন, যা প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল প্লাস্টিক হিসেবে পরিচিত। এটি সেলুলোজ নাইট্রেট এবং ক্যাম্পোর মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল এবং ফটোগ্রাফিক ফিল্ম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক প্লাস্টিক যুগের সূচনা হয় লিও হেন্ড্রিক বেকেল্যান্ডের বেকেলাইট আবিষ্কারের মাধ্যমে। ১৯০৭ সালে লিও হেন্ড্রিক বেকেল্যান্ড বেকেলাইট তৈরি করেন, যা প্রথম সম্পূর্ণ সিন্থেটিক প্লাস্টিক।

এটি ইলেকট্রিক ইনসুলেটর এবং বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯২০ সালে হারমান স্টাউডিঞ্জার ‘পলিমার’ তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, যা প্লাস্টিকের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি প্লাস্টিকের গঠন ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী সময়ে পলিথিন (১৯৩৩), পলিস্টাইরিন, পিভিসি এবং পলিপ্রপিলিন (১৯৫৪) উদ্ভাবিত হয়, যা বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালি এবং শিল্পপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক উদ্ভাবনের মধ্যে পলিথাইলিন টেরেফথালেট (চঊঞ) (১৯৭৮) উল্লেখযোগ্য। এভাবেই প্লাস্টিকের উদ্ভাবন থেকে আধুনিকায়ন পর্যন্ত এর অগ্রযাত্রা ঘটে।  
মূলত, ১৯৫০-এর দশকে প্লাস্টিকের ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয় এবং এটির হালকা ওজন, স্থায়িত্ব ও দামে সস্তা হওয়ায় মানুষকে আকৃষ্ট করে। তবে, এর ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণও দ্রুত বাড়তে থাকে। প্লাস্টিক দূষণ আধুনিক সময়ের একটি বড় পরিবেশগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, ১৯৭০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের চিহ্ন পেতে শুরু করেন, যা সামুদ্রিক জীবজন্তুর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।

১৯৮০-এর দশকে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা শুরু করে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ দেয়। ২০০০-এর দশকে বিভিন্ন দেশ প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ এবং পুনর্ব্যবহার কর্মসূচি চালু করে। ২০১০-এর দশকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা গভীরভাবে চিহ্নিত হয়, যা প্রাণী ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।    
গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক উৎপাদন ১৯৬০ সালে ৫ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ৩৬৭ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৫৩৩ মিলিয়ন টনে পৌঁছানোর অনুমান করা হচ্ছে, যার ৬০% সামুদ্রিক পরিবেশে ফেলে দেওয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঊঁৎড়ঢ়ব ধহফ ঊচজঙ (২০১৯) এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ছিল : ৫১% এশিয়া, ২০% ইউরোপ, ১৮% উত্তর আমেরিকা, ৭% আফ্রিকা, ৪% দক্ষিণ আমেরিকা।

প্রকৃতপক্ষে, প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উৎস হতে প্রথমে নদীতে প্রবেশ করে এবং পরিশেষে তা সমুদ্রে গিয়েই পৌঁছায়। বড় প্লাস্টিক উপকরণ সাধারণত ছোট ছোট অংশে ভেঙে যায় এবং ৫ মিমির চেয়ে ছোট প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিকগুলো ভেঙে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয় যেমন : ভৌত প্রক্রিয়া (সূর্যালোক, তাপ এবং ঢেউয়ের ধাক্কা), রাসায়নিক বিক্রিয়া (রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলে প্লাস্টিকের পলিমার শৃঙ্খল ভেঙে যায়), যান্ত্রিক এবং জৈব প্রক্রিয়া (ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং অন্যান্য জীবাণু প্লাস্টিকের পলিমার শৃঙ্খল ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক সৃষ্টি করে)।

মাইক্রোপ্লাস্টিক মূলত দুই ধরনের হয় : প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো সেই ছোট প্লাস্টিক কণা যা সরাসরি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হয় এবং বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ প্রসাধনী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন ফেশওয়াশ, স্ক্রাব, টুথপেস্টে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও প্লাস্টিক উৎপাদনের সময় ব্যবহৃত ছোট পেলেট যা পরবর্তীতে বড় প্লাস্টিক পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

সিন্থেটিক কাপড় ধোয়ার সময় ফাইবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে পানির মাধ্যমে পরিবেশে প্রবেশ করে। অপরদিকে, সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক মূলত বড় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে গঠিত হয়। পরিবেশে বড় প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক এবং যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিণত হয়। যেমন : প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগ, গাড়ির টায়ার, সিন্থেটিক কাপড়, ফিশিং নেট, প্লাস্টিক পণ্য (যেমন প্লাস্টিকের চেয়ার, খেলনার সরঞ্জাম)।       
মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন প্রকার বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে বায়ুম-ল, স্থলভাগ, পুকুর, নদী, সমুদ্র, দ্বীপপুঞ্জ, উপকূলীয়সহ প্রায় সব পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক এন্টার্কটিকার বরফে এমনকি মানুষের রক্তেও পাওয়া গিয়েছে বলে গবেষণায় প্রকাশিত।

মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ বর্তমান বিশ্বে একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি জলজ প্রাণী থেকে শুরু করে মানুষের স্বাস্থ্য এবং পুরো পরিবেশের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি জলজ প্রাণী যেমন : মাছ, শামুক, কৃমি, প্ল্যাঙ্কটন এবং সামুদ্রিক পাখির শরীরে প্রবেশ করে যান্ত্রিক আঘাত, হজম নালীর প্রতিবন্ধকতা এবং শারীরিক ও প্রজনন সমস্যার সৃষ্টি করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ  নির্গত হয়, যেমন: bisphenol A, alïlphenol, polybrominated dipheûl ethers (PBDEs), organotins, perfluorinated compounds, dioxin, lead, এবং cadmium যা ক্যান্সারের মতো ভয়ংকর রোগের জন্য দায়ী। এছাড়াও, মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে থাকা বিষাক্ত দূষক যেমন: dichlorodipheûl trichloroethane (DDT), polychlorinated bipheûls (PCB), এবং dichlorodipheûl dichloroethylene (DDE) শোষণ করে এবং এগুলো পরবর্তীতে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে এবং শিকারি প্রাণী ও মানুষের দেহে পৌঁছে যা জীব ও মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

এছাড়াও পরিবেশের ওপর এর প্রভাবও ব্যাপক- মাটির গুণগতমানের অবনতি ঘটিয়ে ফসলের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং জলাশয়ের পানির মান নষ্ট করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ প্রভাব ফেলছে- মৎস্য ও সামুদ্রিক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পরিষ্কার করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।    
তাই পরিবেশ এবং জীবপ্রণালীর সুরক্ষার জন্য প্লাস্টিক দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিল যা ২০০২ সালের ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তার ব্যবহার না কমে বরং আরও বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তাই আমাদের আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

প্রথমত, সরকার এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের উৎপাদন কমানো এবং প্লাস্টিক যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য তা বেশি বেশি প্রচার করা। বিধিমালা দ্বারা প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বা এর ওপর করারোপ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়াকে উন্নত করা জরুরি। সংগ্রহের সিস্টেম, পৃথকীকরণ সুবিধা এবং রিসাইক্লিং প্রযুক্তিগুলো উন্নত করে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হার বাড়াতে হবে।

যার ফলে প্লাস্টিক পদার্থের প্রবেশ যেমন : ভূমি, নদী ও সমুদ্রে পড়া হ্রাস করতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, প্লাস্টিক দূষণের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে জানানো এবং সচেতন করা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো উচিত, যেমন : প্লাস্টিক সঠিকভাবে ব্যবহার করা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদার্থের ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং রিসাইক্লিং প্রযুক্তি বাড়ানো।   
তাছাড়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারীদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে পুরস্কৃতকরণ করা যেতে পারে। শহরের আবাসিক এলাকায় ডোর টু ডোর এবং জনবহুল এলাকাগুলোতে ক্যাম্পেন চালানো। স্টেকহোল্ডারের মাধ্যমে উৎসে বর্জ্যগুলো পৃথকীকরণ যেমন: পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য আলাদাভাবে রাখা।  ৫জ (refuse, reduce, reuse, recover and recycle) পদ্ধতি সঠিকভাবে মেনে চলা।

অর্থাৎ প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান করা, কমানো, পুনর্ব্যবহার করা, পুনরুদ্ধার করা এবং পুনর্চলন করা। এছাড়াও, দীর্ঘ মেয়াদির জন্য প্লাস্টিকের বিকল্প উদ্ভাবণ, তার অনুমোদন এবং অনুদান প্রদান করে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। সেক্ষেত্রে ২০১৬ সালে, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মুবারক আহমেদ খান একটি জুটের বায়োডিগ্রেডেবল এড়ষফবহ ইধম উদ্ভাবন করেন, যা পলিথিনের মতো ক্ষতিকর প্লাস্টিকের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে উল্লেখযোগ্য হতে পারে। আর এভাবেই বিভিন্ন কর্মসূচি সমন্বিতভাবে গ্রহণ করে, আমরা আমাদের পৃথিবীকে একটি পরিষ্কার এবং সুস্থ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারি। 

লেখক : গবেষক (পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট

[email protected]

×