একটি দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিকীকরণ
একটি দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিকীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন, পরিবহন, রাস্তাঘাট ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি সুদূরপ্রসারী বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনাই হলো নগরায়ণ ব্যবস্থা। বর্তমানে সকল রাষ্ট্রই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে- কীভাবে সুপরিকল্পিত আধুনিক নগরব্যবস্থা গড়ে তুলা যায়। আধুনিক বিশ্বে সর্বোপরি নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে সুপরিকল্পিত আধুনিক নগর ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিগত সরকার নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল; কিন্তু কাক্সিক্ষত কোনো বাস্তবায়ন করা হয়নি নানা জটিলতার কারণে। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নতুন আলোর মুখ নিয়ে আসবে জনগণের জন্য এই প্রত্যাশা। রাষ্ট্র সংস্কারের নানা ইস্যুর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত নগর পরিকল্পনাও। যেহেতু জনগণই রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান, সেহেতু তাদের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাই সবচেয়ে বেশি।
সাধারণত দুর্যোগের সময় এই ইস্যুটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। যেমন- রাস্তায় জলাবদ্ধতা, অগ্নিসংযোগ, যানজট, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলায় দূষিত পরিবেশ ইত্যাদি নানা সমস্যায় জনগণ এক দুর্বিষহ সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও নগর উন্নয়নে আশানুরূপ পরিবর্তন আসেনি। বিপরীতে দেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের বসবাস যোগ্য তালিকায় বরাবরের মতো পিছিয়ে রয়েছে।
২০২৪ সালের ২৬ জুন প্রকাশিত ইকোনমিস্টের প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বার্ষিক জরিপে উঠে এসেছে, বিশ্বে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় বাংলদেশের ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম, যা বিগত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, নিচ থেকে ঢাকার অবস্থান ৫ম যা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগ ও হতাশাজনক।
সমস্যা নিরসনে এক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের দেশে মূলত শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্রিক শহরে জনসংখ্যার আধিক্য বেশি। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠায় জীবিকার তাগিদে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১২ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যা। এ সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধান পদক্ষেপ স্বরূপ শহরের জনসংখ্যা কমানো প্রয়োজন। এতে শহরে স্থিতিশীলতা আসবে।
সেজন্য দেশের প্রতিটি বিভাগের জেলা ও উপজেলায় শিল্প কেন্দ্রিক নগরী গড়ে তুলতে হবে। এতে মানুষের শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় আর পারিবারিক বন্ধনও বৃদ্ধি পাবে। কারণ, ঢাকার বসবাসরত জনসংখ্যার বড় একটা সংখ্যা স্থায়ী বাসিন্দা নয়। যদি তাদের কর্মসংস্থান নিজ নিজ জেলা ও উপজেলাগুলোতে সৃষ্টি করা যায়, এতে ঢাকার জনসংখ্যার আধিক্য কমবে।
দ্বিতীয়ত, মাঝারি ও ভারী শিল্পকারখানাগুলো স্থাপনের জন্য আলাদা শিল্প এলাকা তৈরি করা। এতে রাস্তা, ড্রেনেজ, পরিবহন ইত্যাদি সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা প্রয়োজন। সারাদেশে মানুষের বসতবাড়ি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অবস্থান থাকায় এতে শব্দ দূষণ, বর্জ্য, ইত্যাদির কারণে মানুষের নানা সমস্যা হচ্ছে। তৃতীয়, আবাসন এলাকায় বাড়ি নির্মাণে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব, ড্রেনেজ, রাস্তা, চিকিৎসাসেবা, জলাধার, বিদ্যুৎ লাইন, খেলার মাঠ, ইত্যাদি সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা চাই।
অর্থাৎ, মানুষের প্রয়োজনে নানা সেবা যাতে তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা দরকার। আমরা প্রায়শই দেখতে পাই যে, অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যখন কোনো স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ হয়, তখন ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। এতে সরু রাস্তা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, উদ্ধারকর্মীদের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। তাই জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক।
আধুনিক শহরে মোট আয়তনের ২০ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। ঢাকায় আছে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। সড়ক থাকা দরকার ২০ শতাংশ; কিন্তু আছে ৮ শতাংশের কম। তাই উন্মুক্ত জায়গা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। চতুর্থত, শহরের ছোট-বড় খাল ও নদীকে দূষণমুক্ত রাখা। গবেষণা সংস্থা ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারে’র জরিপ থেকে জানা যায়, স্বাধীনতাকালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫টি।
এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই- এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস এখন নেই। একই সঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খালও হারিয়ে গেছে। মহানগরী এলাকায় এক সময় খাল ছিল ৭৫টি। অবৈধ দখলদারীর কবলে পড়ায় নদীগুলোর অনেকাংশ ভরাট করা হয়েছে আর বেশিরভাগ খালগুলোতে উচ্ছিষ্ট আবর্জনা পড়ায় এখন মৃতপ্রায়।
তাই শিল্পকারখানার বর্জ্য বিশেষভাবে শোধন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। মাধ্যমিক ও উন্নত শোধন প্রক্রিয়ায় শিল্পবর্জ্য ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দূষণমুক্ত করা যায়। বর্তমানে কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় নদীর পানি তো দূষণ হচ্ছেই, পাশাপাশি পরিবেশও মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত বসতি গড়ে ওঠার কারণে কৃষিজমি, জলাভূমি নষ্ট হচ্ছে; কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃতি, কৃষিজমি, জলাভূমি সংরক্ষণ করা দরকার। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা যদি চলতে দেওয়া হয়, তাহলে কৃষি জমি, নদী, জলাভূমি নষ্ট হতেই থাকবে। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা ও উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা।
এসব পরিকল্পনা অনুযায়ী, পুরো দেশের নদী, খাল, বিল, পাহাড়, বন, সমতলভূমি সংরক্ষণ করে উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ, কোন্ অঞ্চলে কীভাবে উন্নয়ন হবে; কোন্ এলাকায় কি ধরনের শিল্প হবে; কোথায় অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে; কোন্্ এলাকায় জাতীয় মহাসড়ক হবে ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া দেশের সকল স্তরের নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে একটি আদর্শ নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেখানে নগরায়ণ, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, জলাবদ্ধতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসা, উদ্যান, কৃষিভূমি, প্রাকৃতিক খাল, বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থান, ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য থাকবে। ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২%। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এখনই যদি এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে এই সমস্যা ভবিষ্যতে আরও জটিল রূপ ধারণ করবে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং দলীয়করণ মুক্ত রাখতে হবে। ফলে, সুদূরপ্রসারী সুপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে বাজেটে কারসাজি হওয়ার প্রবণতা কমে আসতে পারে। তা না হলে কাগজে-কলমে পরিকল্পনা ও বাজেট হলেও বাস্তবে তা হয়তো স্বপ্নই থেকে যাবে।