ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

শেষ হাসি কে হাসবেন- ট্রাম্প নাকি কমলা

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশিত: ২১:০৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শেষ হাসি কে হাসবেন- ট্রাম্প নাকি কমলা

ডোনাল্ড ট্রাম্পে ও কমলা হ্যারিস

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নির্বাচনী প্রচারে নেমে প্রথম সমাবেশেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন। নভেম্বরের নির্বাচনকে তিনি প্রাক্তন প্রসিকিউটর এবং দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার লড়াই হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসের দৌড় থেকে নিজের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে তার রানিং মেট কমলা হ্যারিসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে। তারপর এটাই ছিল  হ্যারিসের প্রথম প্রচার সমাবেশ। যদিও বিশ্বজুড়ে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে গণতন্ত্র। চরম এক অস্থিরতায় ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেবল দেশটির নাগরিকদের কাছেই নয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর কাছেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এমন তথ্যই দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা ও জনগণ। এ নির্বাচনের ফল তাদের জন্য কী বয়ে নিয়ে আনতে পারে, সেই হিসাবও কষছেন তারা। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ নির্বাচনকে। অনেকের মতে, রাজনীতিতে নতুন ধারার পথ দেখাচ্ছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার জনসমর্থনও তুঙ্গে। তবে দেশের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক অজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ট্রাম্প।

সম্প্রতি পেনসিলভানিয়ায় এক জনসভায় আকস্মিক হামলার শিকার হয়েও অল্পের জন্য রক্ষা পান সাবেক এ প্রেসিডেন্ট। এতে নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। এবারের নির্বাচনে তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিস। দলের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন কুড়িয়েছেন এশীয়-আমেরিকান এ কৃষ্ণাঙ্গ নারী। 
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন ৪৯ শতাংশ। তার চেয়ে দুই শতাংশ পিছিয়ে কমলা হ্যারিস। অথচ মাসখানেক আগের এক জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে ছয় শতাংশ এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। কমলা সেই ব্যবধান ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছেন।

জলবায়ুবিদরা বলছেন, আগামী নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে যে লড়াই হবে, তাতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, বৈশ্বিক জলবায়ু নীতিতেও প্রভাব পড়বে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন আগেই নিশ্চিত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে কমলা হ্যারিসের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে দলীয় মনোনয়ন। নির্বাচনের বাকি আর ১০ সপ্তাহ। এখন থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনার চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামলেন ট্রাম্প ও কমলা। 
বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, হোয়াইট হাউসে যাওয়ার দৌড়ে তুমুল প্রতিযোগিতা হবে ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে। জাতীয় সম্মেলন শেষে শিকাগো থেকে নিজের নির্বাচনী পালে হাওয়া লাগিয়ে ফিরছেন সাবেক সিনেটর ও অ্যাটর্নি কমলা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে যাওয়ায় গত মাসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন নিশ্চিত হয় তার। বিভিন্ন জরিপে বাইডেনের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু কমলা এসে সে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেন এবং ট্রাম্পকে ছাড়িয়ে যান।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে কমলার প্রচার দলের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন ড্যান ক্যানিনেন। সম্মেলনের ফাঁকে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। ক্যানিনেন বলেন, ‘নির্বাচনী লড়াইয়ে মৌলিকভাবে সেই অর্থে কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং এটি এখনো খুবই কঠিন লড়াইয়ের জায়গায় আছে। আমাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। আমি মনে করি, পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে।

তবে এর সঙ্গে আমাদের আরও কিছু করতে হবে এবং এই শরতে ভোটারদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।’ শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চারদিনের সম্মেলনের শেষদিন আনুষ্ঠানিকভাবে দলের মনোনয়ন গ্রহণ করেন কমলা। এই সম্মেলনে বসেছিল তারকাদের মিলনমেলা। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাবেক প্রেসিডেন্টদের পাশাপাশি দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারাও এতে উপস্থিত হয়েছিলেন।

এই সম্মেলন থেকেই ৫ নভেম্বরের চূড়ান্ত লড়াইয়ের যাত্রা শুরু হয় কমলার। ক্যালিফোর্নিয়ার ৫৯ বছর বয়সী রাজনীতিক কমলা জরিপে সামান্য এগিয়েও রয়েছেন। বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকার সময়ের জরিপগুলোতে দেখা যায়, বাইডেনের বিপরীতে জয় পেতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। পরে কমলাকে সমর্থন দিয়ে আকস্মিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বাইডেন। এরপর জরিপের ফলও পাল্টে যেতে দেখা যায়। মাত্র এক মাসের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করেছেন কমলা। বর্তমানে তিনি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা মধুচন্দ্রিমা পার করছেন।

শীঘ্রই যে এর অবসান হবে, সে লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবে দলের নেতারা সতর্ক করে বলছেন, পাল্টা ঝড় এখনো নির্বাচনী প্রচারণার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে দেশটিতে চলা বিক্ষোভ। পাশাপাশি ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা রয়েছে। এটিও ভোটের হিসাবে প্রভাব ফেলতে পারে।

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় মনোনয়ন গ্রহণের পর ভাষণে কমলা হ্যারিস বলেন, তিনি সব মার্কিনের প্রেসিডেন্ট হবেন। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়বেন। এ সময় গাজাযুদ্ধ বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অতীতের তিক্ততা, বিদ্বেষ ও বিভেদমূলক লড়াইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আরও বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

জনগণের পক্ষ থেকে, প্রত্যেক মার্কিনের পক্ষ থেকে; দল, জাতি, লিঙ্গ বা আপনার দাদি যে ভাষায় কথা বলেন, তা নির্বিশেষে আমি আপনাদের মনোনয়ন গ্রহণ করছি। তবে তা কোনো একটি দল বা উপদলের সদস্য হিসেবে নয়, মার্কিন হিসেবে। তিনি নিজের মনোনয়নকে একটি নতুন পথ তৈরির সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে বলেন, ট্রাম্প মার্কিন ভোটারদের রায় ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।

তা করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি একটি সশস্ত্র উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ক্যাপিটলে পাঠান, যেখানে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। কিন্ত তিনি যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন তাহলে মার্কিন জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করবেন। ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে হারানোটা একেবারেই অপরিহার্য বিষয়। স্বৈরশাসকদের কাছে ট্রাম্পের মাথা নত করার অভিযোগ করেন কমলা।

বিশ্বজুড়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যকার স্থায়ী সংগ্রামে নিজের এবং আমেরিকার অবস্থান কোথায়, তাও তিনি জানেন। 
বাইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের নামটি উচ্চারিত হতেই আমেরিকার ভোটরঙ্গ মঞ্চে সাড়া জাগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লড়াই হবে তুল্যমূল্য। কোন্ কোন্ কারণে কমলা হ্যারিস এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন? কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে দিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরও যে চাঙ্গা, সেটা চাঁদা আসার পরিমাণ দেখেই অনুমেয়।

ডেমোক্র্যাট দলের ফান্ড ম্যানেজাররা উৎসাহের সঙ্গে জানিয়েছেন, হ্যারিসের নাম সামনে আসার পরেই ফান্ডে একদিনে ৬০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা জমা পড়েছে। তাহলে ধরে নিতে হয়, অতি দক্ষিণপন্থি আইকন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে প্রার্থী হিসেবে জো বাইডেন টিকতে পারবেন না, বরং খড়কুটোর মতো উড়ে যাবেন এই আশঙ্কা তীব্র ভাবেই ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের লড়াই হলে তাতে অন্য পরিপ্রেক্ষিতও থাকবে।

এরই মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কমলা হ্যারিসের প্রাথমিক পরিচিতি তৈরি হয়েছিল একজন সফল আইনজীবী ও কড়া সরকারি অ্যাটর্নি হিসেবে। কমলা হ্যারিস আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, আর বিপরীতে ট্রাম্প আইনের চোখে অপরাধী। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই এমন দুজনের মধ্যে হবে- যেখানে একজন আইনের হাতকে শক্তিশালী করা, মহিলাদের আইনি অধিকারের জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে পারেন এবং এর বিপরীতে থাকছেন একজন ধনকুবের, যিনি নিজের যৌন সংসর্গের কিচ্ছা গোপন রাখতে বেআইনি পথ বেছে নেন।

রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত মার্কিন মূল্যবোধের ভোটারদের কাছেও কমলা হ্যারিসের অন্যরকম আবেদন থাকতে পারে, যাকে সদা বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে অতিক্রম করে যাওয়া সহজ হবে না।  আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে যিনি জয়ী হবেন, তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হবেন। কিন্ত এখনও নির্বাচনের দুই মাস বাকি। আমেরিকার নির্বাচন বলে কথা। কখন যে কোন্দিকে মোড় নেবে তা সময়ই বলে দেবে। তাই ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হচ্ছে।

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক

[email protected]

×