ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

ইলিশ সংকট উত্তরণ জরুরি

সুধীর বরণ মাঝি

প্রকাশিত: ২১:০৪, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইলিশ সংকট উত্তরণ জরুরি

ইলিশ মাছ

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Tenualosa ilisha. ফিশবেইসের তথ্যমতে, বৈশ্বিকভাবে ইলিশকে বলা হয় হিলসা শ্যাড এবং আলোস হিলসা। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আগমন করে। বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক  বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

ইলিশ মাছ রপ্তানি করেও বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ইলিশ মাছ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টি উপাদানেও ভরপুর। এই প্রজাতির মাছ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানো এবং ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। চর্বিযুক্ত হওয়ায় মাছটিতে বিদ্যমান ভিটামিন ‘এ’ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড চোখের জন্য উপকারী। ইলিশ রক্ত কোষের জন্যও বিশেষভাবে উপকারী। এপিএ ও ডিএইচএ নামক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে বলেই ইলিশ মাছ দেহের রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে রয়েছে ২৫ গ্রাম প্রোটিন, ২০৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩ দশমিক ৩৯ গ্রাম শর্করা, ২ দশমিক ২ গ্রাম খনিজ ও ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি। আরও রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন বি১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস।  ইলিশ ভিটামিন ডি’র ভালো উৎস। ভিটামিন ‘ডি’ মানবদেহে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে।

ইলিশে থাকা আয়োডিন, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো বিভিন্ন খনিজ উপাদান রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে, কোষের সংক্রমণ কমাতে ও থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বহু গবেষণায় উঠে এসেছে, সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের সুরক্ষায় যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখে। শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোধ করতে পারে ইলিশ। যারা নিয়মিত মাছ খান, সাধারণত তাদের ফুসফুস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অবসাদ দূর করতে সহায়ক। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (এসএডি), পোস্ট-ন্যাটাল ডিপ্রেশন (সন্তান প্র¯্রব-পরবর্তী বিষণœতা) কাটাতেও সাহায্য করে ইলিশ মাছ। বাংলাদেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ আহরণ করা হয় বাংলাদেশে। কিন্তু  এর পরিমাণ বর্তমানে অনেক কমে এসেছে। 
ভরা মৌসুম চললেও মেঘনাপাড়ের জেলেরা ভুগছেন ইলিশ সংকটে। দিনরাত নদীতে জাল ফেলেও কাক্সিক্ষত  ইলিশের দেখা মিলছে না। ফলে, বাজারে সকলের প্রিয় এই মাছের দামও এখন স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। ইলিশের দেখা না পেয়ে বাড়ছে জেলেদের ঋণের বোঝা। আমাদের অতিমাত্রার লোভ, শব্দদূষণ, নদীর নাব্য সংকট ও দূষণের  ফলে দিন দিন ইলিশের উৎপাদনও কমছে।

নাব্যসঙ্কটে দেশের অনেক নদী আজ মৃতপ্রায়। রয়েছে নদী দখলদারদের আগ্রাসনও। দূষণের ফলে কত নদী যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ইলিশের আঁতুড়ঘর এবং অবাধে বিচরণ রয়েছে এমন অনেক নদীতে মাছটির উৎপাদন কমে আসছে।  এভাবে চলতে থাকলে আমাদের জাতীয় মাছ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ ইলিশ মাছের নাম অচিরেই বিলুপ্তপ্রায় মাছের তালিকায় চলে আসতে পারে। 
সংশ্লিষ্টদের মতে, এখনো সময় এবং সুযোগ আছে এই সংকট উত্তরণের। মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষার অভিযানের বিষয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কাজেই জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার অভিযান সফল এবং মৎস্য সম্পদকে রক্ষা করতে হলে প্রশাসনের কাজের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা চাই।  আইনের সঠিক প্রয়োগ  এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকর পন্থা।

 সেই সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালত, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডসহ অন্যদের টহল আরও জোরদার এবং প্রত্যেকের কাজের সমন্বয় জরুরি। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উৎপাদন এবং আমদানি বন্ধ করা দরকার যেকোনো মূল্যে। জাটকা ও মা ইলিশ নিধনে কেউ যেন কোনো প্রকার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে। এক্ষেত্রে জেলে এবং নাগরিকদের আরও সচেতনতা কাম্য।

জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে চলমান সভা-সমাবেশ, লিফলেট, ফেস্টুন ইত্যাদি এবং গণমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচার আবশ্যক। জেলেদের জন্য  মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষার অভিযানের সময় মাছচাষ কেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি, যা হবে সামাজিক মালিকাধীন। মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার প্রশাসনের কোনো রকম অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

সেই সঙ্গে জেলেদের বোঝাতে হবে যে, ইলিশ মাছের মালিক তারাই। তাই ইলিশ রক্ষা এবং লালন-পালনের মূল দায়িত্ব তাদের। এক্ষেত্রে সরকার এবং প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ সহযোগী। সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করলে এক সময় যেমন সন্তান তার পিতামাতার দায়িত্ব নেন, ইলিশ নদীর অন্যান্য মাছও জেলেদের জীবনে ঠিক তেমনি।
ইলিশের সংকট ঘুচাতে এবং কাক্সিক্ষত উৎপাদন বৃদ্ধিতে আসুন, মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। অপরাধীরা সংখ্যায় কম হয়েও আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রশাসন যত কঠোর হবে, জাটকা এবং ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম তত সফল হবে।

জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা করতে পারলে জেলেদের জীবনে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, নিরাপত্তা আসবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। ডলার সংকট মোকাবিলায়ও ভূমিকা রাখবে। আমরা মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার সফল অভিযান দেখতে চাই। তা যতই কঠোর ও কঠিন হোক। নদীর পানি দূষণমুক্ত এবং নদীর প্রবাহ ও গভীরতা ঠিক রাখতে  ডুবোচর, নদী ও সাগরের মোহনা নিয়মিত ড্রেজিং করা দরকার।  
লেখক : শিক্ষক

×