ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

সত্য, সৎ ও সততা

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সত্য, সৎ ও সততা

.

মানবতাবাদী আধ্যাত্মিক সাধক লালন ফকিরের একটি গান-/‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা-/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি-সবই দেখি না না॥

১৭৭৪ সালে জন্ম নেওয়া এই মহান ব্যক্তিটির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি মানব জাতির মনের গভীরে ডুব দিয়ে যা আহরণ করেছেন, সেই আহরিত বস্তুকে সমাজ জীবনে ছড়িয়ে দিয়ে জাত পাতের ভেদাভেদকে উপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর রচিত অসংখ্য গান সমাজ জীবনকে প্রভাবিত করেছে। তিনি লালন ফকির নামে সমধিক পরিচিত। এই উপমহাদেশে তিনিই প্রথমমহাত্মা, উপাধিতে ভূষিত।

কোনো সুনির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী না হয়েও সকল ধর্মের মাহাত্ম্যকে ধারণ করে মানবতা বা মনুষ্যত্ব বিকাশে কাজ করেছেন। জন্য তাঁকে অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়েছে। লালনের জীবনী নিয়ে লেখার জন্য কলম ধরিনি। এমন মহান ব্যক্তির জীবনী লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আজ থেকে সোয়া দুইশবছর আগে সমাজ জীবনের বিচিত্র পথরেখা নিয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। আজকের সমাজ জীবনেও তাঁর গানগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। এই যে তিনি বলেছেন সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি - না- না- আজও সত্য কাজে বা সৎ কাজে মানুষের অরুচি লক্ষ্য করছি- দিনে দিনে অরুচিবান লোকের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না! যে জন্য সমাজ জীবনে এত অস্থিরতা; এত অশান্তি।

সত্য, সৎ সততা, এই তিনটি শব্দকে কেন্দ্র করে যদি জীবনকে সাজিয়ে তোলা সম্ভব হয়, তবে জীবনের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করা সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বা করি। বাংলা ব্যাকরণগত দিক থেকে সত্য, সততা, দুটো শব্দই বিশেষ্য পদ। আরসৎ, শব্দটি বিশেষণ পদ।সৎ, এর বিশেষ্য পদটি হচ্ছে সততা। জীবনের একটা ব্যাকরণ থাকে- আমরা মুনষ্য জাতি সেই জীবনের ব্যাকরণকে অস্বীকার করে যাচ্ছি। এই অস্বীকারের প্রবণতাই আমাদের ডুবাচ্ছে।

আমরা যদি সত্যি সত্যি একবার বিশ্বা করি যে, মানুষের ভবিষ্যৎ হলো মানবজাতির অধিকতর সাফল্য মানব সমাজ কর্তৃক কীর্তির পরিপূর্ণতা অর্জনের সম্ভবনাকে বাস্তবায়িত করা, তা হলে মানুষের প্রথাগত প্রয়োজনীয় বস্তু বলতে যা বোঝায়, তা গৌণ হয়ে পড়ে। দ্রব্য সম্ভারের উৎপাদনের পরিমাণ অবশ্যই কিছুটা দরকার। মাথাপিছু খাদ্য বা পানীয় বা দূরদর্শন যন্ত্র কিংবা কাপড়কাঁচা যন্ত্রের কিছুটার বেশি থাকা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয়,বরং খারাপও বটে।

দ্রব্য উৎপাদনের পরিমাণ আরও বড় পরিণামে পৌঁছবার উপায় মাত্র; কিন্তু সেটাই শেষ পরিণাম নয়। দক্ষ কর্মীরা কি শান্তিপ্রিয়? তারা কি পরস্পরের সঙ্গে শান্তি বজায় রেখে বসবাস করে? তারা কি পরস্পর সেবা করে? প্রশ্নগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানব জীবনে গুণগতমান বৃদ্ধির দ্বারাই সমাজ থেকে যুদ্ধ, হিংসা অপরাধ প্রবণতা সম্পূর্ণভাবে দূর হতে পারে। ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। গুণগত মান বৃদ্ধি ঘটে সত্য, সৎ সততা দ্বারা। বাংলাদেশে আমরা আমাদের জীবনে কাজের দিকটাকে উপেক্ষা করছি। বর্তমানে দিকটার উন্নতি ঘটানো দরকার। কাজটি মনুষ্যত্ব বিকাশের কাজ। আমাদের দারিদ্র্য পশ্চাৎপদতার মতো সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়, যদি না আমরা কাজ, দক্ষ কাজ সংঘবদ্ধ কাজের ওপর জোর দেই। এই সংঘবদ্ধ কাজের প্রেরণা আসবে জাতীয় চরিত্র উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। সত্য সন্ধানে দৃষ্টি নিবন্ধন করে আমরা যখন ভালো কর্মী হব, পণ্যদ্রব্য উৎপাদন পরিষেবামূলক কাজকর্ম করতে থাকব, তখনই আমরা গণদরিদ্রের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হব। ১৭ কোটি লোক যদি যথেষ্ট খেতে পায়, উপযুক্ত শিক্ষা পায়, সর্বসুবিধাযুক্ত বাড়িতে বসবাস করতে পারে, তবে তা হবে একটা চমৎকার উন্নতির উদাহরণ।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের আগস্ট একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। টানা পনেরো বছর শাসনকালের অবসান হলে অনেকেই এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন বলে মন্তব্য করেন। ছাত্ররা সাধারণ মানুষ এখন রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। নোবেল বিজয়ী . ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার হলেই একটি গ্রহণযোগ্য, ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন দেবে। সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত হবেন তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা অনুশীলনে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রাষ্ট্রে সংস্কারটা কিভাবে হবে? এর প্রক্রিয়াটা কী? প্রশাসন যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের রদবদল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বদল, কিংবা সরকারি পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবর্তন আনাটাই কেবল সংস্কার নয়। সংস্কার আনতে হবে মানুষের চরিত্রে।

যেভাবে লোভ-লালসা লুটেরা চিন্তার সংস্কৃতি এই দেশে গড়ে উঠেছে, তাতে রাষ্ট্রকাঠামো বা প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তনে কতটুকু লাভ হবে। দরকার সত্য, সৎ সততার নিমিত্তে কর্ম প্রকরণ। সেটা কিভাবে? প্রশ্ন উঠতে পারে! বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশুরই একটা স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি আছে। এই চিন্তাশক্তিকে কখনো বাধাগ্রস্ত করা সমীচীন নয়।আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতির একটা উদ্দেশ্য হলো শিশুদের চিন্তাশক্তির গুণটির উন্মেষের পথরোধ করা। এতে শিক্ষায় চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ না করেও মহান চিন্তাশীল ব্যক্তির উদ্ভব ঘটেছে। এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে রয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চারিত্রিক বলসম্পন্ন চিন্তাশীল শক্তির উন্মেষ ঘটবে না। তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে হবে পরিবর্তন। বর্তমান শিক্ষায় কেবলই উন্মদনা, সাময়িক উত্তেজনা।

এটা পরিবর্তন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। তবে আপাত ক্ষেত্রে আপেক্ষিক নয়, উচ্চতর সত্যকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলে কেউ কেউ সংবিধানকে পুনর্লিখনের কথা বলছেন? এটা তো কাগজে লেখার পরিবর্তন! রাষ্ট্র পরিচালনায়৭২-এর সংবিধানে অনেক মহৎ আদর্শ রয়েছে। আমরা যদি সেই মহৎ আদর্শের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক আনুগত্য দেখাতে পারি, তবে অন্তত কিছুটা মুশকিল আসান হতে পারে। স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত আমরা কী সেই সংবিধানের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক আনুগত্য দেখাতে পেরেছি? পারি নাই। পর্যন্ত কয়েক বারই আমাদের নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।

কিন্তু যাত্রাপথে কোনো সততা ছিল না। যে জন্য বারবার হোঁচট খেয়েছি। হাসিনা সরকারের পতনের পরঅর্থাৎ থেকে আগস্টের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত কার্যত বাংলাদেশে কোনো সরকারই ছিল না। সরকারবিহীন একটা রাষ্ট্রে ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারত কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ যথেষ্ট ভালো, পরস্পরে প্রীতিবন্ধনে চলে আসছি সুদীর্ঘকাল থেকে। বিচ্ছিন্ন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; কিছু হত্যাকা-, খুন-খারাবি, ¦ালাও পোড়াও লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে, এগুলো কিছু দুষ্ট লোকের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। ভালো মানুষগুলো একতাবদ্ধ নয়, দুশ্চরিত্রবানরা একতাবদ্ধ। যে কারণে হামলার ঘটনা ঘটে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির খবর এখন সামনে আসছে। দুর্নীতি কেন হয়েছে, তার কারণ  রয়েছে অনেক। আমি সে কারণের ব্যাখ্যা এই লেখায় দিতে চাই না। কমবেশি সব সরকারের আমলেই দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির উৎস ধারায় আঘাত হানতে হবে সততার শক্তি প্রয়োগে। আমাদের সমাজে ব্যাপক সংখ্যক লোক আছে, যারা দেশে কল্যাণকর বিষয় ঘটলে আনন্দিত হয় না, আবার অকল্যাণকর কিছু ঘটলেও বিমর্ষ হয় না’- সব লোকের মনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। এটা বুঝতে হবে। এদেরই প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। এদের কাজে লাগাতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনকেই শিক্ষার উদ্দেশ্য রূপে স্বীকার করা উচিত। সেই সত্য সম্বন্ধে প্রত্যেক মানুষের মনে সততার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে জীবন যাত্রায় সুফল বয়ে আনবে এবং সংস্কার দেখতে পাব।    

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

×