জলবায়ুর প্রভাবে বৃক্ষরাজি ও কৃষি সম্পদ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বেই স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। বরং তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটি। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘জার্মানওয়াচ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে প্রথমেই বাংলাদেশের অবস্থান।
এছাড়াও ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ‘ম্যাপলক্র্যাফ্ট’-এর তালিকায় রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম স্থানে। অর্থাৎ বিভিন্ন সংস্থার ভিন্ন তালিকায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে সর্বশীর্ষে। বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে পানিতে লবণাক্ততাও।
অন্যদিকে, হিমালয়ের বরফ গলা জলের প্রভাবে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক বন্যাসহ নদ-নদীর দিক পরিবর্তন। সঙ্গে যোগ হচ্ছে নদীভাঙন। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বখ্যাত মরুভূমি গবেষকরা বাংলাদেশকে সতর্কও করে আসছেন বারবার।
দেশের এ সমস্যাগুলোকে বাংলাদেশ ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মতো ‘পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়’ কর্তৃক দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের চারটি মানদ- বিবেচনা করেছে। যেমন- এক. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুই. প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন্ অঞ্চলে বেশি হচ্ছে। তিন. কোন্ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চার. ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কি না।
বাংলাদেশ ঋতুভেদে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিধস ইত্যাদি মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ঋতুচক্রের হেরফেরের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও হেরফের ঘটছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে তাপমাত্রার পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। যার প্রভাবে বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা, মরুকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশে জলবায়ুগত পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে।
ফলে, বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে নদ-নদীর পানি প্রবাহ প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, নদীর পানির বিশাল চাপ না থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা, ততটুকু জায়গায় থাকছে না। পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসছে।
ফলে, উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে বাইন ও সুন্দরী গাছসহ অন্যান্য গাছের আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে।
তাতে আবার নানা ধরনের পাতাখেকো কীটের আবির্ভাবও ঘটেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কীটপতঙ্গের সম্পৃক্ততা কোথায়? বিষয়টি হচ্ছে ইকোসিস্টেম। ফলে, কোনো অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন হলে, সেই অঞ্চলের প্রাণিকূল অথবা কীটপতঙ্গের জীবনধারায়ও পরিবর্তন চলে আসে।
এমনও হয়, সেই অঞ্চলের প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটে, নতুন প্রাণিকুলের সৃষ্টি হয়। মূলত এভাবেই উক্ত অঞ্চলের জলবায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন প্রজাতির কীটের আবির্ভাব হয়। যেমন- সুন্দরবনেও বিভিন্ন প্রজাতির নতুন কীট জন্মেছে। অন্যদিকে, গাছ-গাছালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
দেশীয় প্রজাতির গাছ-গাছালি হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিদেশী গাছের আগ্রাসন। বিদেশী এসব গাছ ও লতাগুল্মের ক্রমাগত বর্ধনের ফলে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে অন্তত হাজারখানেক প্রজাতির নিজস্ব গাছ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিদেশী আগ্রাসী গাছগুলো এখন আমাদের দেশীয় প্রজাতির গাছ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে। যেমন- সেগুন, মেহগনি, আকাশমণি, রেইনট্রি, বাবলা, চাম্বল, শিশু, খয়ের ও ইউক্যালিপ্টাস গাছ এখন অনেকের কাছে দেশীয় প্রজাতির গাছ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
যে গাছের আগ্রাসী দাপটে দেশী প্রজাতির গাছ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জাতীয় গাছগুলোর জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশী গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে মাটি থেকে বেশি পরিমাণে পুষ্টি শুষে নেয়। এছাড়াও আশপাশে দেশীয় প্রজাতির গাছের বেড়ে ওঠায় বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায়। মূলত এ গাছগুলো ব্রিটিশ আমলে এতদঅঞ্চলে বিভিন্নভাবে আনা হয়েছে। যা আজ দেশীয় প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু সুন্দরবনেই নয়, দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তেমনি অনেক প্রজাতির পাখপাখালি, জীবজন্তু, ফুল-ফল, গাছ-গাছালি দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। ইউনেস্কোর ‘জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের প্রায় ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাতে দেশের বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাসের কারণে পরিবেশের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিকাজের ওপরেও ধারাবাহিক অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে। খরা এবং তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধির কারণে বহু প্রজাতির ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তেমনি আগাছা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঞ্চলভেদে মাটির উপাদানে তারতম্য ঘটছে এবং কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
বোরো উৎপাদনে প্রচুর সেচের পানির প্রয়োজন পড়ে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জমিগুলোতে লবণাক্ততার কারণে সেচেও বিপত্তি ঘটছে। আবার লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে চিংড়ি চাষেও ব্যাপক ধস নেমেছে। অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলে সেচের পানিতে আরেক বিপত্তি ঘটছে। সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি হওয়ায় ফসলের মাধ্যমে তা মানবদেহে প্রবেশ করছে। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানি ফসলের ক্ষেতে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
যে কারণে ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার নিচে নেমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ না হলে শুধু দেশের নি¤œাঞ্চলই প্লাবিত হবে না, মরুকরণ ঝুঁকিও বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে আমাদের বনজ ও কৃষিজ সম্পদের ওপরেও। যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তখন অনেক কঠিন হয়ে যাবে। সুতরাং নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে নিজেদেরই সচেষ্ট হতে হবে। দেশের আনাচে-কানাচে বন সৃজন করতে হবে।
আগ্রাসী গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ বা বায়ুদূষণ ঘটে এমন ধরনের কাজকর্ম থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। সর্বোপরি, শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে প্রামাণ্য চিত্রসহ আমাদের আর্জি তুলে ধরতে হবে। তাহলে রাতারাতি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব না হলেও আমরা যথেষ্ট উপকৃত হব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশবিদ