.
দেশের মানুষের স্বস্তি ও শান্তিই কাম্য। মানুষ আশা করে একটু স্বস্তিতে বসবাস করবে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন উৎফুল্লভাব নেই। আপামর জনতা চায় সুন্দর ও নিরাপদ জীবনযাপন। বাঙালি মিশ্রজাতি, আবেগ-অনুভূতি ভিন্ন হলেও গণতান্ত্রিক চিন্তা ও বাক্স্বাধীনতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি বিপ্লবী প্রজন্ম ও একটি অভ্যুত্থানই বড় প্রমাণ বহন করে। বাংলাদেশের মানুষ জেগে ওঠার শক্তি রাখে। নিশ্বাস ধরে থাকা মানুষের মাঝে ফুঁসে ওঠা দেখে বিশ্ব সত্যি হতবিহ্বল হয়েছে। ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশ এখন আলোচিত দেশ। স্পষ্টত, বাংলাদেশকে কেউ একনায়কোচিতভাবে ধরে রাখতে পারবে না, এটি হচ্ছে টার্নিং পয়েন্ট ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কৃষি ও কৃষক সমাজ দেশের প্রধান অংশীদার। খরাÑঅতিবৃষ্টির ফলে এবং বন্যাজনিত কারণে যখন চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটে, ফসল বিনষ্ট হয়, তখনও কৃষক সচেষ্ট থাকে। উৎপাদন থেকে কখনো মুখ ফিরিয়ে নেয় না; ঘাম ও শ্রম দিয়ে কৃষি খাতকে রক্ষা করে। সার, কীটনাশক ও বুর্জোয়া শ্রেণির হস্তক্ষেপে বাধাপ্রাপ্ত হলেও বারবার কৃষি উৎপাদনে হাত লাগায়। যতবার পরাস্ত হয়, ততবার বীজের পরিচর্যা করে। কৃষকের কাছে, চাষাভুষার কাছে দেশই কবিতা। কৃষক ও মাছচাষিরা প্রকৃতির ভাষা বোঝে, প্রকৃতির সঙ্গে খেলা করে, দুর্যোগে মৃত্যু উপত্যকা পাড়ি দেয়। তাদের মনোবল কখনো ভাঙে না ; শত বিপদেও মন শক্ত থাকে। তারা উৎপাদন না করলে সব্জিবাজার হুড়হুড় করে বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
এলিটশ্রেণি খেতে পায় না; জিহ্বায় স্বাদ তৈরি করতে পারে না, আহ্লাদী আপ্যায়ন করতে পারে না। কৃষক শ্রমিক ও মাছচাষিদের মন ও মানসিতা না বোঝার কারণে আজও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ সমাজ নির্মিত হয়নি। সময় অসময় গড়ে উঠেছে বুর্জোয়া, সিন্ডিকেট ও ফ্যাসিবাদী শ্রেণি। দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। সিন্ডিকেটের উপদ্রবে নাকাল হয়েছে কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্য সরবরাহ। মনে হচ্ছে চেপে ধরেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। অথচ সঠিক মূল্য ও সুবিধা প্রাপ্তির মাধ্যমে একটি আদর্শ শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল। সম্ভব ও সম্ভাবনাকে তোয়াক্কা করা হয়নি। নিজস্বার্থ ও সুবিধা লাভের আশায় তৈলী মাসেজ ছিল নিয়মিত। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসা নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষা পেলেও সুশিক্ষা না পাওয়ায় মৌলিকত্ব বিনষ্ট হয়েছে। মাধুর্য ও ত্রুটি নিরূপণ হয়নি। দুটি সমাজ থাকবে কিন্তু দুটোকে আলাদা করে দেখানোর উপায়কগণ নির্জীব ছিলেন।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ হচ্ছে প্রভাববিস্তারকারী রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে দলিত ও মথিত। তারা বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে। কম তো হলো না, ব্রিটিশ শোষণ, পাকিস্তানি শোষণ, বুর্জোয়া শোষণ। শোষকরা সুবিধা ও সুবিধালোভী। বাজারজাতে সব সময়ই জোটবদ্ধ। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাজার দখল। চীন, আমেরিকা ও রাশিয়াসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যাপী তা করছে। তবে জাপানকে একটু আলাদাভাবে বিবেচনা করা চাই। সভ্যতা ও সহিষ্ণুতা তাদের প্রধানতম উপকরণ। চিন্তা ও গবেষণায় তারা সচ্ছল। অন্যের খবরদারী করছে না, নিজেদের টেকসই প্রযুক্তি ও বিজনেস পলিসিনীতি নীরবে ব্যবহার করছে।
কিন্তু অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ যা দেবে তা সুদে-আসলে কড়ায় গন্ডায় বাগিয়ে নেয় এবং ঘাড়ে চেপে বসে। তদুপরি বাংলাদেশকে সুসম্পর্ক রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। সাধারণ ও গণচিন্তার দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ বিভিন্ন দেশে কাজ করে। শ্রমবাজার রপ্তানিতে শীর্ষে। বাড়তি আয় ও রোজগারের আশায় পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি দেয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবার পরিজনকে সুন্দর রাখা। ইতোমধ্যে প্রবাসীদের পরিবারগুলো স্বাচ্ছন্দ্যজীবন খুঁজে পেয়েছে। প্রবাসে যাওয়ার কারণ হচ্ছে দেশীয় বেকারত্ব, শিল্প ও শ্রমবাজার দুর্বল। আর্থিকভাবে অর্থাৎ বেতন কাঠামো যৎসামান্য। অথচ কোটি কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মৌলিক খাতগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। দেশীয় শিল্প, কলকারখানা গড়ে ওঠেনি; কেবল দেদার পাচার হয়েছে। পাচারকারীরা সবাই শিক্ষিত দাপ্তরিক কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক এবং রাজনীতিবিদ। কিন্তু দায় টানতে হয়েছে জনতা, শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষক সমাজকে।
শিক্ষকরা সমাজের আইকন। কিন্তু তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে আন্দোলন করতে হয়, দিনের পর দিন অনশন করেও কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি পাওয়া যায় না; দেশের বৃহৎ অংশ বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। যাদের মনের কথা বোঝার সক্ষমতা কারও হয় না। এর প্রধানতম কারণ লেজুড়বৃত্তিক চিন্তা। দেশ ও সমাজ দুটো বিষয়কে মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক হবেন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু এসব কখনো দূর হবে কি না তা সন্দেহাতীত। গবেষক ও গবেষণাগার কম। সঠিক গবেষণা না হলে কখনোই মানসম্মত ও উপযোগী সভ্যতা গড়ে ওঠে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৌলিক বিষয় শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা, নদীব্যবস্থা, নগরায়ণ গড়ে ওঠেনি। বারবার হোঁচট খেয়েছে। কারণ, হচ্ছে সমালোচনা নেওয়ার মানসিকতার অভাব, আর্থিক অনিয়ম, রাজনৈতিক ট্যাগ লাগানো তেলবাজি এবং চাটুকারিতা। খাত বিশেষ মাধুর্য খুঁজে পেলেও ত্রুটিও যে আছে, তা দেখানোর সাহস কারও ছিল না; দেশ স্বাধীনের পর এক্স, ওয়াই ও জেডসহ তিন প্রজন্ম চলছে। অপেক্ষা করতে হবে কী হবে এবং কী হতে পারে।
স্বাধীনতা রক্ষা এবং জনস্বার্থ বিবেচনা করার মূল শক্তি হচ্ছে গণতন্ত্র। সবাই মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেছে, বাস্তবিকপক্ষে গণতন্ত্রের গলা চেপে ধরে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। গণতন্ত্র লুণ্ঠিত হলে রাষ্ট্রকে প্রভু রাষ্ট্রগুলো চেপে ধরার সাহস পায় এবং হামলে পড়ে। চাহিদা বেড়ে যায় এবং অন্যায় আবদার তৈরি হয়। চীন আমেরিকা ও ভারত এমনটাই করেছে। এমন অশুভ নজরের জন্য বারবার দায়ী হয়েছে গণতন্ত্রহীনতা। মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর বাঙালিকে দাসত্বে রাখা সোজা কথা নয়Ñ তা প্রমাণিত। যে কোনো শাসকই বহুজাতিক সমস্যা মোকাবিলা করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম, হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ ও আদিবাসী। এর মাঝে রয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভাজিত জনগোষ্ঠী। বহুমতের সন্নিবেশ আছে এখানে। একক কিংবা আংশিক চিন্তায় রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও শিকড় তৈরি করা যাবে না। এদেশের মানুষের আবেগ, সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কিন্তু কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়। কারণ, আবেগ নিয়ে খেলা করা অসমীচীন। তাই ভোট, দল মতের মেনুফেস্টোর চাহিদা রাখতে হবে।
দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠা কেন? সততা-নিষ্ঠা, আদর্শ রাষ্ট্র কাম্য ছিল। কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতার অভাব। দুর্নীতির বড় শিকড় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। আমলাশ্রেণি রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের চাবিগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখে এবং লকআপ ও ভ্যান করার সক্ষমতা রাখে। শর্ষের মধ্যে ভূত। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব, জনতার কথা মাথায় রাখে না; ভোগের রাস্তাগুলো রাজনীতিবিদের তারা তৈরি করে দেয়। নিজেদের স্বার্থে ভোল পাল্টিয়ে আবার নতুন সাজে আসে এবং লুটপাট শুরু করে। রাজনীতিবিদ, শিল্পগোষ্ঠী ও সিন্ডিকেট এবং আমলাদের দুর্নীতির অভয়ারণ্যে দেশের বারোটা বাজে, দৌরাত্ম্যে জনগণের চাহিদা ও স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। ধুঁকছে জনতা। কিন্তু তাদের সন্তানাদি ও পরিবার পরিজন নামি দামি রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করে। নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিত করে। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের দেশ নেই, দল নেই, মত নেই, ধর্ম নেই। তারা হচ্ছে দুর্বৃত্ত ও পরগাছা। যতদিন পরগাছা বিলুপ্ত না হবে, ফলবান বৃক্ষের তদারকি না হবে, ততদিনে মুক্তি নেই। জনতা বিদ্বেষহীন একটি সুন্দর ও নিরাপদ জীবন প্রত্যাশা করে।
কন্ডিশন পুঁজিবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া ফিলোসোফি দিয়ে কখনো শঙ্কর জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। ফিলোসোফি কেবল একটি শ্রেণি কিংবা আদর্শবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীতে ব্যবহৃত হয়, বাকি যা করা হয় চাপিয়ে দেওয়া এবং জোরজবরদস্তি করা। এসব করে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। এজন্য মৌলিকত্ব খুব বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশ একটি আবেগীয় ও বহুজাতিক জনগোষ্ঠী। স্ব স্ব আইডিয়া কিংবা আইডলজি বহন করে।
ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে চায় না, এটা পরিষ্কার। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানে সার্বিক অংশগ্রহণ ও সমৃদ্ধি খুব প্রয়োজন। রক্তে আবেগী যন্ত্রণা আছে, দাগ আছে, প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা আছে। ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য ইতিহাস হাজার বছরের। তাই প্রজন্ম এবং জনতার আবেগ ও ইন্দ্রিয় বুঝতে হবে, কথা শুনতে হবে। শোনা বোঝার মধ্যে সময়টাও বেশি নেওয়া যাবে না। কারণ, তাতে বিপদাপন্ন হওয়া সহজ। সেন্স জাস্টিস ও মূল্যবোধ নিরূপণে জনতার সঙ্গে এলিটশ্রেণির সম্পর্ক অটুট রাখা জরুরি। মতাদর্শের কারণে সম্পর্কের অবনতি কিংবা বিরুদ্ধপ্রভাব কাম্য নয়। সবার ঊর্ধ্বে রাষ্ট্র ও দেশপ্রেম।
হিংসা-বিদ্বেষশূন্য সমাজ ও রাষ্ট্র প্রত্যাশা। উদ্ভূত পরিস্থিতি চায় না জনতা। পুঁজিবাদী সমাজের ভয়ংকর ও কুৎসিত চেহারা জনতা দেখতে চায় না। চক্রের বিরুদ্ধে ফের সমষ্টিগত সমাজ উজ্জীবিত। কিঞ্চিত অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, অধিকার চর্চায় জনতা সদা সচেতন। বসন্তের কাছে দুর্নিবার শক্তি পরাজিত। এটুকু মাথায় রেখে সম্মুখে হাঁটা নিরাপদ। কারণ, জনতাই শক্তি।
লেখক : সাংবাদিক