.
বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যায় কমপক্ষে ১০টি জেলা বন্যাকবলিত। মরছে মানুষ আর বাড়ছে আর্থিক ক্ষতি। হয়তো এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বাংলাদেশের এই বন্যা পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ত্রিপুরার গোমতী নদীতে ভারতীয় বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমরা বাংলাদেশে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি যে, ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের জেলাগুলোতে বন্যার বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবে এটি সঠিক নয়। সেখানে আরও বলা হয়েছে, আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর ক্যাচমেন্ট এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে এই বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের এই বৃহৎ ক্যাচমেন্টের পানির কারণে ঘটেছে।’
ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশে নিয়মিত বন্যা হয়। এ দেশের ওপর দিয়ে ৪০৫টি নদী বয়ে গেছে এবং প্রধান প্রধান নদীর উৎপত্তির স্থল দেশের বাইরে। যখন একটি নদী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার নদী বলে। বাংলাদেশের নদীর অববাহিকাগুলো হলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। এগুলো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও চীনে বিস্তৃৃত।
এই অববাহিকার ৯৩ শতাংশ এলাকার অবস্থান বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি এলাকা, মধুপুর গড়, লালমাই পাহাড় ও বরেন্দ্র ভূমি ছাড়া অধিকাংশ জায়গায়ই প্লাবন ভূমি (Flood plain) এবং অর্ধেকের বেশি অংশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ ধেকে ৮ মিটার উচ্চতায়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, পরে এই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে নিচু এলাকাগুলো যেমন: হাওড়, বিল, ঝিলগুলো বৃষ্টির পানি দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
সুতরাং বর্ষা ঋতুতে স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকে। নদীর পানি যখন নদীর তীর বা বাঁধ উপচে প্লাবন ভূমিতে ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, তখন সেই অবস্থাকে বন্যা বলে। পানি যে উচ্চতায় উঠলে এলাকার ফসলি জমির বা ঘরবাড়িসহ রাস্তাঘাট, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই উচ্চতাকে বিপদসীমা হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশে চার ধরনের বন্যা হয়। বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি ও নদীর পানি প্রবাহের মাত্রার ওপর নির্ভর করে বন্যার ধরন। এর একটি হলো মৌসুমি বন্যা (Monsoon flood)। সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো ও তাদের শাখা বা উপনদীগুলোতে ধীরে ধীরে পানি বৃদ্ধি পায়। তখন নদীর তীর বা পার্শ্ববর্তী বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
ফলে, বন্যা দেখা যায় সেই অঞ্চলে। এ ছাড়া আছে আকস্মিক বন্যা (Flash flood)। দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি নদীগুলোতে আকস্মিক বন্যা হয়। এই বন্যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত হ্রাস পায়। পাহাড়ি এলাকায় ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়। ফলে, এ ধরনের বন্যা ফসল ও মানুষের বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক ক্ষতি করে। অনেক সময় আকস্মিক বন্যায় মানুষের জীবনহানিও ঘটে থাকে। আর আছে বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা (Rainfed Flood)। তীব্র মাত্রায় দীর্ঘ স্থায়ী বৃষ্টিপাত এবং পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের বন্যা হয়ে থাকে। ইদানীং শহর এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা বেশি হয়। এ ছাড়া আছে উপকূলীয় বন্যা (Coastal Flood)। বাংলাদেশে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ও মোহনায় জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় বন্যা হয়।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য বড় ভূমিকা পালন করে দেশের তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা। জুন মাস থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্রুত বাড়তে থাকে এবং জুলাইয়ের প্রথমার্ধে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। তখন এই অববাহিকার জেলা কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জের নিম্ন এলাকায় বন্যা হয়। আবার জুলাই মাসের শেষে এবং আগস্টের প্রথমার্ধেও ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি আরেকবার বাড়ে এবং পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে এবং বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, গঙ্গা অববাহিকায় জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং আগস্ট মাসে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এপ্রিল-মে মাস থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মেঘনা অববাহিকা এলাকায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রাক্-মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি হয়। এই বন্যাকে আকস্মিক বন্যা আবার আগাম বন্যাও বলা হয়ে থাকে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় নদী- সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, কংশ, যদুকাটা ইত্যাদিতে পানি একাধিকবার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মেঘনা অববাহিকার বন্যার কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বন্যা হয়। এই তিন অববাহিকার প্রধান নদীর পানি একই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে যুগপৎভাবে। সর্বোচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ও মারাত্মক আকার ধারণ করে, যেমনটি ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কার্বণ নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে এবং জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি বাড়তে থাকলে ২০৭০ থেকে ২০৯৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ সর্বনিম্ন ১৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বন্যায় প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে গুরুতর মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সংকটেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরন, আকস্মিক বন্যার তীব্রতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। গবেষণা বলছে, জলবায়ুু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবের কারণে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বব্যাপী জরুরি ও বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক : আইনজীবী, সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন