ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১

বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনাকে পরিণত করুন জনসম্পদে

নাজমুল হাসান শেখ

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৪ আগস্ট ২০২৪

বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনাকে পরিণত করুন জনসম্পদে

আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে যে বিপুল জনসম্পদ

আমরা দেখি, প্রাচীনকাল থেকেই বিপুল জলস্রোত মানুষ কাজে লাগিয়ে চাকা ঘুরিয়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। এক সময় তা চাষাবাদের কাজে অথবা শস্য মাড়াই করার কাজে ব্যবহৃত হতো। যা পরবর্তীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের উচিত, বর্তমানে উদ্যমী এবং সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এই তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছা এবং উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা।

আগামীতে বাংলাদেশ কর্মক্ষম জনসংখ্যার কারণে যে বোনাস পেতে যাচ্ছে, তার জন্য দরকার আমাদের সুশৃঙ্খল, শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম জনশক্তি। আসুন, আমরা এই ঐতিহাসিক সুযোগ এবং সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করি এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই

আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে যে বিপুল জনসম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারী, তা আরও একবার সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের দিনগুলোতে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এবং ’৯০ এ এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা জনগণের এ রকম উচ্ছ্বাস এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখেছিলাম। আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতি এবং প্রতিবারই দেখা গিয়েছে যে, কয়েক সপ্তাহ অথবা মাসের মধ্যেই এই আবেগ উবে যায় কর্পূরের মতো। 
গত কয়েকদিন ধরে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং রাস্তা পরিষ্কার করেছে, তা সত্যি বিস্ময়কর ও আশাব্যঞ্জক। আমাদের এখন উচিত হবে তরুণ এবং যুব সমাজের এই গঠনমূলক মানসিকতাকে পরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে কাজে লাগানো। এ ব্যাপারে কিছু কর্মসূচি ও পরিকল্পনার প্রস্তাব করতে পারি, যা পরবর্তীতে বিস্তারিতভাবে প্রদান করা যেতে পারে।
এসএসসি এবং এইচএসসি পাসের পর সকল ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক এক বছরের (এসএসসি পরীক্ষার পর ৬ মাস এবং এইচএসসির পর  ৬ মাস) মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে এসএসসির পর প্রথম তিন মাস তাদের শৃঙ্খলা, শরীরচর্চা, ট্রাফিক কন্ট্রোল, কমিউনিটি পুলিশিং, মশক নিধন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো সামাজিক দায়িত্ব পালন। পরবর্তী তিন মাস মৌলিক কারিগরি, কৃষি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া।

এর মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ জনসম্পদ গড়ে তোলার বুনিয়াদ রচিত হবে। যারা এসএসসিতে আশানুরূপ ভালো ফল করবেন না, তারা তাদের পছন্দের কারিগরি, কৃষি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে ভোকেশনাল কোর্স করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। 
এসএসসি পরীক্ষার পর প্রত্যেকেই তার মেধা এবং আগ্রহ অনুযায়ী কৃষি, স্বাস্থ্য, কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতির মধ্য থেকে যে শ’খানেক ট্রেড কোর্স পড়ানো হয়, সেখান থেকে তারা ১২ সপ্তাহের কোর্স সম্পন্ন করার চেষ্টা করবে। এই কোর্স যেমন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, তেমনি ভবিষ্যতে পেশা নির্বাচনে তাদের হাতে কলমে বুঝতে সাহায্য করবে।

ফলে তারা নিজেরাই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পরে আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে নাকি এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে, সে সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা লাভ করতে পারবে। যার ফলে কলেজে ভর্তি ইচ্ছুক হতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে এবং তুলনামূলকভাবে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই  কলেজে ভর্তি হবেন। 
আবার দুই বছর পর এইচএসসি পরীক্ষার পরও একই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেরাই ভবিষ্যৎ পেশা গ্রহণের ব্যাপারে আরও পরিষ্কারভাবে চিন্তা করবেন। আরও চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়াশোনা করলে তাদের পক্ষে চাকরি পাওয়াটা কতটা সহজ হবে, সেটা তারা উপলব্ধি করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

একইভাবে শুধু অত্যন্ত মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন এবং অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা করার উদ্দেশ্যে চাহিদা অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করবেন। ফলে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বা পড়তে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। যার ফলশ্রুতিতে উচ্চশিক্ষিত বেকার বা বেকার সমস্যা কমে যাবে অনেকাংশে।
আমরা যদি এখন থেকে আমাদের এই তরুণ ছাত্র সমাজকে সঠিক দিকে ধাবিত করতে না পারি এবং তাদের বর্তমান উদ্যমকে কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে চার থেকে ছয় বছর পর উচ্চশিক্ষিত বেকারের চাপে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এইচএসসির পর প্রথম তিন মাস প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। যারা এইচএসসি পরীক্ষায়  আশানুরূপ ভালো ফল করবেন না, তারা তাদের পছন্দের কারিগরি, কৃষি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে যেমন এবং যে কোনো একটি কারিগরি শিক্ষা যেমন- আধুনিক কৃষি এবং খামারের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ, প্রোগ্রামিং, কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং, বিভিন্ন ধরনের মেক্যানিক, নার্সিং জাতীয় কোর্স সম্পন্ন করা যেতে পারে। ফলে ডিপ্লোমা অর্জন করে নিজেকে জনসম্পদে পরিণত করার পাশাপাশি অত্মনির্ভরশীল হতে পারবেন। 
এসব প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় কোর্সের মধ্য দিয়ে ছাত্র এবং যুব সমাজের নাগরিক সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়, যদি তাদের আন্তরিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তারা সেই শিক্ষা গ্রহণ করে। এই কোর্সগুলো করার ফলে দেশের জরুরি অবস্থা অথবা যে কোনো সংকটে তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রিজার্ভ থাকবে এবং তাদের কাজে লাগানো যাবে।

সংকট বলতে বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা বহিশত্রুর আক্রমণ হতে পারে। এই কোর্স যারা করবেন তারা দুইবার সনদপ্রাপ্ত হবেন। সনদগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এবং পরবর্তী জীবনে সরকারি চাকরির আবেদনের সময় ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে এইচএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে।
আমরা দেখি, প্রাচীনকাল থেকেই বিপুল জলস্রোত মানুষ কাজে লাগিয়ে চাকা ঘুরিয়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। এক সময় তা চাষাবাদের কাজে অথবা শস্য মাড়াই করার কাজে ব্যবহৃত হতো। যা পরবর্তীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের উচিত, বর্তমানে উদ্যমী এবং সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এই তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছা এবং উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা।

আগামীতে বাংলাদেশ কর্মক্ষম জনসংখ্যার কারণে যে বোনাস পেতে যাচ্ছে, তার জন্য দরকার আমাদের সুশৃঙ্খল, শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম জনশক্তি। আসুন, আমরা এই ঐতিহাসিক সুযোগ এবং সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করি এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই।

লেখক : প্রাক্তন  ফ্যাকাল্টি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিউপি

×