ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

বঙ্গবন্ধুকে দলীয় বলয় থেকে বের করে আনুন

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:২৫, ১৩ আগস্ট ২০২৪

বঙ্গবন্ধুকে দলীয় বলয় থেকে বের করে আনুন

আগামীকাল ১৫ আগস্ট ২০২৪ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী

আগামীকাল ১৫ আগস্ট ২০২৪ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং বহিঃশক্তি তাকে তার বাসভবনে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে গঠিত সরকারগুলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানাভাবে পুনর্বাসন করে এবং দীর্ঘদিন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বীরোচিত সম্মান দেয়।

আমরা যারা আশির দশকের শেষ ভাগে স্কুল শুরু করেছি, তারা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সাত বীরশ্রেষ্ঠর জীবনী ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব কমই জানতে পেরেছি। এমনকি পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নামও ছিল না। সেগুলোতে যুদ্ধে পরাস্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নামও লেখা থাকত না। সেখানে তাদের উল্লেখ করা হতো হানাদার বাহিনী হিসেবে।

পরবর্তীতে নিজে পড়ালেখা করে জানতে পেরেছি যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নাম লেখা হতো না কারণ, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মানুষজনের আধিক্য ছিল এবং তাদের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়াকে আনন্দের সঙ্গে মেনে নিতে পারতেন না। আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর আগ মুহূর্তে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

আজকের লেখাটা এমন একটা সময়ে লিখছি, যে সময় জাতি হিসেবে আমাদের সামনে একটা অত্যন্ত কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। গত ৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে দেশ ত্যাগ করেন এবং গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলের যবনিকাপাত ঘটে।

যদিও পালাবদলের এই ঘটনাগুলো সাংবিধানিকভাবে হয়নি এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা এখনো কোনো সুনিশ্চিত ধারণা রাখি না, কিন্তু এটি বলতে দ্বিধা করার কোনো সুযোগ নেই যে, কোটা আন্দোলন নিয়ে মধ্য জুলাই থেকে ছাত্রদের যে বিক্ষোভ সেটি গণতান্ত্রিকভাবে নিরসন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেবল ব্যর্থই হননি, বরং নানা সময়ে প্রেস কনফারেন্সে, জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে চিনেছি, জেনেছি এবং তাদের উন্নয়ন কাজে সমর্থন দিয়েছি, তারাও যেভাবে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে, পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছেÑ তাতে হতবাক হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। একের পর এক ছাত্রের মৃত্যুর পরও সরকারের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখিনি বরং একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের মাধ্যমে তাদের দমন নিপীড়নের চেষ্টা দেখেছি। 
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন পর্যন্ত ১৫ আগস্ট শোক দিবসের ছুটি জারি আছে। তবে এই ছুটি জারি থাকবে কিনা এখনো নিশ্চিত থাকতে পারছি না। গত কয়েকদিনে কয়েকজন উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে এই বিষয়ে কিছু সন্দেহের অবতারণা হওয়া বিস্ময়কর নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, তিনি সাধারণ নাগরিকও নন, রাজনীতিবিদও নন, তিনি ফৌজি।

একজন উপদেষ্টা, যিনি কিনা ‘স্বৈরাচার’ পতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি কিভাবে নিজেকে সাধারণ নাগরিক দাবি করতে দ্বিধা করেন এবং প্রকাশ্যে বলতে পারেন যে, কেউ চাঁদাবাজি করলে যাতে জনতা তাকে ধরে পিটিয়ে পা ভেঙে দেয় তা আমার বোধগম্য নয়। একইভাবে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, যেহেতু বাংলাদেশের একটি ‘ম্যাসাকারের’ সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম জড়িত আছে এবং যেহেতু উপদেষ্টা পরিষদ মনে করে তিনি সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত, তাই তারা তার নাম সব জায়গা থেকে মুছে ফেলবেন।

কেবল তার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয় নয়, সকল মন্ত্রণালয় একই কাজ করবে। তার বক্তব্যের এই জায়গাটা আমাকে আবারও বিস্মিত করেছে এবং শেখ হাসিনার নাম পরিবর্তনের চাইতেও যে দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তা তারা কেন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে নির্ধারণের চেষ্টা করছেন না, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে। একইভাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ গ্রহণ করার পর যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে তিনি এত অল্প সময়ে এতবার ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ ধারণাটি উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের চিন্তিত করেছে।

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ২০২৪ এ যা হয়েছে তাকে নির্মোহভাবে বলতে গেলে বলা যায় ‘সরকার বদল’, বড়জোর ‘স্বৈরাচার পতন’, কিন্তু সেটিকে বারবার ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলাকে উদ্দেশ্যমূলক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোস মনে করলে তা অবিবেচনাপ্রসূত হবে বলে মনে করি না।
এটি বলতে দ্বিধা নেই, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টা সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের প্রথম আলাপচারিতায় যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের আরও অনেক সদস্য আছেন যারা আগে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি এটি উল্লেখ করব যে, ড. আসিফ নজরুলের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এই আন্দোলনের সময় তিনি যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় রেখেছেন।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে প্রকাশ্যে করা তার আপত্তিকর মন্তব্য ছাড়া বেশিরভাগ সময় তিনি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। এমনকি সরকার বদলের পর যে হত্যা-নির্যাতন, তারও প্রতিবাদ করেছেন। এটি সত্য যে, তিনি বিএনপির নানা সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন। এটি মনে রাখা দরকার, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যে কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা দোষের কিছু নয় এবং এটি ব্যক্তিস্বার্থের অন্তর্ভুক্ত।

আমি এও মনে করি, নিবন্ধিত প্রতিটি দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার দাবি রাখে। এখন তাদের সমর্থকদের ভোটের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার নির্বাচন করার অধিকার থাকা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত না থাকাটা কেবল দুর্ভাগ্যজনকই নয়, দৃষ্টিকটুও বটে।

একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন পর্যন্ত উপদেষ্টাম-লীর দৃষ্টিভঙ্গি হতাশাব্যঞ্জক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙা প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, ‘এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণ হাসিনা সম্পর্কে কী অনুভব করে। হাসিনা নিজে যা করেছেন নিজের জন্য এবং তার পিতার জন্য, তারই ফল এটা। তিনিই এমন ক্ষতি অর্জন করেছেন। এটা যুব সমাজের ত্রুটি নয়। এটা হলো শেখ হাসিনার ভুল।’

প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য অনেককেই আশাহত করেছে। এটি আমরা অবগত যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার শাসনামলের পুরোটা সময় ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকে নানাভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন করেছেন, কিন্তু ড. ইউনূসও যদি একই পথে চলেন তাহলে জাতি হিসেবে আশাবাদী হওয়া কঠিন হয়ে যায়। 
সারাদেশে চলমান অস্থিতিশীলতা, স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন আমাদের উৎকণ্ঠিত করছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আমরা আরও দায়িত্বপূর্ণ আচরণ ও বক্তব্য প্রত্যাশা করি। শেখ হাসিনার কোনো আচরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করা হবে, এটি কোনো সুবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য হতে পারে না।

এই ক্রান্তিকালীন সরকার যে আসলে কোনো প্রকার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এবং জনগণের স্বার্থ মাথায় রেখে সরকার পরিচালনা করবে, সেটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে, যদি তারা ১৫ আগস্ট ২০২৪, সকলে মিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। তার প্রতি  দেশব্যাপী যে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে আশু ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা থেকে আমি শঙ্কিত যে, এই অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গে যদি বঙ্গবন্ধুকেও অবজ্ঞা-অবহেলা করে, তবে এই মুহূর্তে না হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই আলোচনাটিরও অবতারণা করতে চাই যে, এখনই সঠিক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের একক গ-ি থেকে বের করে নিয়ে এসে বাংলাদেশী জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

যেহেতু এটি একটি জাতীয় ঐক্যের সময়, তাই কারও যদি এমনকি ‘জাতির জনক’ ধারণায় আপত্তি থাকে, তবে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশী জাতির স্থপতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হোক। আমরা গত অর্ধশতক ধরেই দেখে আসছি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হয় অতিরিক্ত মাতামাতি কিংবা অবমাননা করার একটি প্রবণতা। এখন সময় এসেছে এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে তাকে জাতির জনক কিংবা স্থপতি হিসেবে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগেরও উচিত হবে তাকে তাদের একক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য না করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।

আওয়ামী লীগের কোনো ভুল কাজের জন্য কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো নেতার স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার যদি সেটি না বুঝে আগের সরকারগুলোর মতো তাকে অশ্রদ্ধা ও অসম্মানের পথ বেছে নেয় তবে তাদের পক্ষেও বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

এটি মনে রাখা দরকার, দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের পর যে কোনো নতুন সরকারকেই মানুষ সাময়িকভাবে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। কিন্তু তারা যদি কাজে-কর্মে অপরকে যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন না করে, তবে তারাও একই ভাগ্যকেই বরণ করে নিতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, আশা করব তিনি নিজের ব্যক্তিগত মান-অভিমান প্রশমিত করে জনগণের প্রত্যাশাকে মূল্য দিয়ে এই জাতিকে একতাবদ্ধ করতে পারবেন। আর সেই পথে প্রথম পরীক্ষাই হবে তিনি তার উপদেষ্টাম-লীকে নিয়ে ১৫ আগস্ট জাতির জনকের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কিনা! 

১২ আগস্ট ২০২৪

[email protected]

×