ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

মৎস্য আহরণে স্মার্ট প্রযুক্তির সফলতা

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১২ আগস্ট ২০২৪

মৎস্য আহরণে স্মার্ট প্রযুক্তির সফলতা

গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া

গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকারের ফলে মৎস্যজীবীরা একদিকে যেমন অনেক লাভবান হচ্ছে অন্যদিকে সমুদ্রের সার্বিক পরিবেশ জলোচ্ছ্বাস, আবহাওয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদি জানার পাশাপাশি স্থলভাগে মৎস্য ঘাটে মাছের বাজার দর এবং  পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ, ফিশ ফাইন্ডার, ইকো সাউন্ডার, অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি মৎস্য শিকারে ব্যবহৃত হচ্ছে। আরও আছে ওফিশ অ্যাপ, রিমোট কনট্রোল অপারেটেড ফিশ ফিডার, অটোমেটিক পদ্ধতিতে পানির গুণাগুণ নির্ণয়, স্মার্ট সেন্সর, স্মার্ট আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তি।

মৎস্য আহরণে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সফলতা এবার আলোচনা করা যাক। গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ : ইন্টারনেট অ্যাক্সেসসহ বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করতে এবং ব্যক্তিগত জাহাজের ট্র্যাক, সামুদ্রিক ফিশিং ও সুরক্ষিত এলাকা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে সক্ষম। সমুদ্রে অতিরিক্ত মাছ ধরা, অবৈধ মাছ ধরা এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস  হচ্ছে কিনা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব।

গুগলের সহায়তায় প্রযুক্তিটি ২০১৬ সালে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়াশিংটন ডিসিতে মহাসাগর সম্মেলনে স্থাপন করা হয় এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০১৭ সালে একটি স্বাধীন ও অলাভজনক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 
গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ মাছের সংগৃহীত তথ্য ভিজুয়ালাইজ করে ৭২ ঘণ্টা পর ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। এই ভিজুয়ালাইজেশনে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কেউ এই তথ্য ব্যবহার করতে পারে। সংগৃহীত তথ্য দিয়ে একটি মেরিন ডেটা ব্যাংক তৈরি করা হয়, যেখানে সাগরের তাপমাত্রা, পানির লবণাক্ততা ও অক্সিজেনের মাত্রা ইত্যাদি তথ্য জমা থাকে।

গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচের এই উদ্যোগ অবৈধভাবে মৎস্য আহরণকারী ভেসেলগুলোর মালিক ও ক্যাপ্টেনদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ফিশ ফাইন্ডার এবং ইকো সাউন্ডার : গভীর সমুদ্র তলে মাছ শনাক্ত করার ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি শোনার মতো শব্দশক্তির মাধ্যমে পানির ভেতরে উচ্চ তরঙ্গ তৈরি করে গ্রাফিক্যাল ডিসপ্লেতে প্রতিফলিত শব্দের পরিমাপ প্রদর্শন করে এবং সুমদ্রে মাছের অবস্থান শনাক্ত করতঃ স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতিচিত্র পাঠায়।

এক্ষেত্রে স্মার্টফোন ও  ফিশ ফাইন্ডারের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০ ফুট হতে হয়। কারণ এই রেঞ্জের মধ্যে ব্লু-টুথ ভালোভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। মাছের অবস্থান নির্ণয় ছাড়াও, ফিশ ফাইন্ডার দিয়ে পানির গভীরতা এবং তাপমাত্রা জানা যায়। আধুনিক ইলেকট্রনিক ফিশ ফাইন্ডার সিস্টেম, সামুদ্রিক রাডার, কম্পাস এবং জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেমের মধ্যে একটি ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস। সিস্টেমটি মাছের অবস্থান নির্ণয় ছাড়াও পানির নিচের কাঠামো সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদান করে। ফলে মাছ ধরার সম্ভাবনাকে উন্নত, সময় ও শ্রম বাঁচাতে সহায়তা করে।

আন্তর্জাতিকভাবে পানির গভীরতা নির্ণয় করার জন্য জাহাজে ব্যবহৃত ইকো সাউন্ডারকে প্রায়শই ফ্যাদোমিটার বলা হয়। কারণ সমুদ্রে পানির গভীরতা পরিমাপের একক হিসেবে ফুটের পরিবর্তে ফ্যাদম ব্যবহৃত হয়।
অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা : শব্দ উৎস স্থানীয়করণ পদ্ধতি যেমন শব্দ স্তরের মিটার এবং মানুষের কানের তুলনায় বেশকিছু সুবিধা প্রদান করে। এই ক্যামেরা অত্যন্ত নির্ভুল, সুনির্দিষ্ট এবং কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বা অ্যাক্সেস করা কঠিন বা বিপজ্জনক এলাকায় শব্দ উৎস স্থানীয়করণ করতে ব্যবহার করা হয়।

ক্যামেরাটিতে ৬৪ থেকে ১০২৪ মাইক্রোফোনের একটি অ্যারে রয়েছে, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। একে অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা অ্যারে বলে। এই অ্যারে উৎপন্ন হয় সমুদ্রের গভীরে মাছের অবস্থান (উচ্চতা ও গভীরতা), অনুভূতি সাপেক্ষে মাছের শব্দ, চাপ, স্তরের উৎস খুঁজে একটি বিস্তৃত ফ্রিকোয়েন্সি পরিসীমা ব্যবহার করে একটি পরিমাপ ক্যাপচার করে। যা পরবর্তীতে মোবাইল মনিটরে দৃশ্যমান হয়।

এ পর্যায়ে পানির বিভিন্ন গুণাগুণ যেমন পানির স্তর, তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, ঢ়ঐ, ঙজচ, পরিবাহিতা এবং অস্বচ্ছতা অটোমেটিক পদ্ধতিতে পরিমিত হয়। অনেকে ব্যবহার করেন ‘স্মার্ট আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা’। পেশাদার এবং অপেশাদার মৎস্যজীবীদের জন্য দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সরাসরি এবং পরিষ্কারভাবে মাছ দেখতে, মাছের অঞ্চলগুলো খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।

মাছের লোকেশন বুঝতে  অনেক জেলে টলনেট ব্যবহার  করেন যা ট্রলারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাছের ঝাঁক বোঝার জন্য সোলার নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা অনেকদূর থেকেও কাজ করে।
মৎস্য শিকারে ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ (জিপিএস) ব্যবহারে এসেছে অনেক সফলতা। বিস্তীর্ণ জলরাশিতে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনা যেমন ঘটে। পাশাপাশি এসব মৎস্যজীবীর আরেক ভয় ডাকাতের। মৎস্যজীবীর ছদ্মবেশে দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা প্রতিবছর মাছ লুট, অর্থ ডাকাতি, খাবার কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে অনেক জেলের জীবনহানির খবরও পাওয়া যায়।

অবশ্য সাগরে জলদস্যুতা রোধে জাহাজগুলোতে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) করা হয়। এর মাধ্যমে জেলেরা দ্রুত কোস্টগার্ড অথবা নৌবাহিনীর কাছে সাহায্য বার্তা পাঠাতে পারে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সহজ হয়। ইলেকট্রনিক মনিটরিং সিস্টেম, কম্পিউটার ভিশন টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে জলজ পরিবেশের যে কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে জানা যায় এবং সে অনুযায়ী মাছ শিকার করা হয়।

যদিও জিপিএস-এর মাধ্যমে এখন এগুলো অনেকটা নিরসন হয়। নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াও সাগরে মৎস্য সম্পদ আহরণে কতসংখ্যক ট্রলার বা নৌযান কোন অবস্থানে রয়েছে তা মনিটরিং হচ্ছে জিপিএসের মাধ্যমে। যদিও গুগল অ্যাপস ব্যবহার করে তা সম্ভব হচ্ছে। ওফিশ অ্যাপের মাধ্যমেও জেলেদের নিয়মিত আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। এটি মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে অনেকটা গুগল ম্যাপের মতো কাজ করছে।

জেলেরা এই অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই তার নিকটবর্তী ফিশিং জোনগুলো সম্পর্কে জানতে পারছেন। তবে স্যাটেলাইট ও সেলুলার নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্যপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে এই ধরনের সমস্যা দূর করা সম্ভব। গ্লোবাল ডায়ালগ অন সিফুড ট্রেসেবিলিটি সাপ্লাই চেনে সিফুডের সরবরাহ ট্র্যাক করে অটোমেটেড সিস্টেমে। ক্রেতারা কোনো রকম বিভ্রান্তি ছাড়াই জানতে পারেন যে, তাদের সিফুড কোথা থেকে আসছে এবং সেগুলো কতটা টেকসই উপায়ে আহরণ করা হয়েছে ইত্যাদি।

ক্রমবর্ধমান মানব জাতির ন্যূনতম মাছের চাহিদা মেটানো এক চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে এসব স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সাগরে ফিশিং ভেসেলগুলোর মাছ ধরার সক্ষমতা প্রতিবছর গড়ে অন্তত ২ শতাংশ বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্টিক টন।

২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপন্ন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন ছাড়িয়েছে অর্ধকোটি টন। এভাবে গত এক যুগে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আগামী ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৫ লাখ টন। বর্তমানে ১৪ লাখ নারীসহ ২ কোটি অর্থাৎ প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ এই পেশায় জড়িত। এদিকে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭ হাজার ৪০৮ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার ৪৯৬.৩৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে এবং আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৮ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০৫০ সালে হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য মৎস্য সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×