গ্রিন ব্যাংকিং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
জলবায়ুর দিক থেকে ভৌগোলিকভাবে একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশে আমরা বসবাস করি। জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় নেওয়া নানা কার্যক্রমের মধ্যে ‘গ্রিন ব্যাংকিং’ অন্যতম। যা বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ‘স্যার জুতা পলিশ করেন, নগদ টাকা দিতে হবে না। কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকাটা আমাকে মোবাইলে দিয়ে দিলেই হবে।
এখন আর খুচরা টাকা নিয়ে ঝামেলা নাই স্যার।’ রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে বসে এভাবেই সেবা নেওয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন শাপলা। এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। তাই সম্পূর্ণভাবে ক্যাশলেস সোসাইটির যুগে আমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এটা করতে পারলে অনেক ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দিতে পারবে না। এর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নেটওয়ার্ক থাকবে, কার কত বিক্রি হয়, যার ওপর বিক্রি কর দিতে হবে
গ্রিন ব্যাংকিং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রিন ব্যাংকিং হলো সামাজিক, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং নৈতিকভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে এবং যা বিশ্বের বর্তমান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করবে। সরকার এবং আমাদের সবাইকে গ্রিন ব্যাংকিং অনুশীলনে উৎসাহী হতে হবে। সরকারকে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন ব্যাংকিংয়ের জন্য নীতি-নির্দেশিকা প্রবর্তন করে। কিন্তু নীতি কার্যকর করার ১৩ বছরেও গ্রিন ব্যাংকিং শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি; যার দায় অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। কারণ, ঘুষ বা দুর্নীতিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন বটে, তবে এসব কাজে যেন আমরা পিছিয়ে থাকি। গ্রিন ব্যাংকিং চালু করা গেলে ক্যাশলেস সোসাইটি করা যাবে। গত জুন মাসে ১৫ দিন চীনে অবস্থান করি।
যেখানে কোনো নগদ টাকার লেনদেন করতে হয়নি। যা আমাদের যাতায়াতে এবং লেনদেন করতে নিরাপদ রেখেছে। গ্রিন ব্যাংকিং নীতি বাস্তবায়ন হলে পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব। ফলে গাছ কাটা কম হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে কাজ করবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত গতিশীল অর্থনীতির একটি দেশ। তবে বর্তমান সংকট আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশে প্রায়ই ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। দেশের সামাজিক ও অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ। যার জন্য সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা বা নীতি প্রয়োজন। যা পাবলিক এবং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। সামাজিকভাবে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশ রক্ষা এবং আমাদের স্বাভাবিক জীবনে গ্রিন ব্যাংকিং অসামান্য ভূমিকা পালন করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গ্রিন ব্যাংকিং একটি অপরিহার্য বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও রয়েছে নানা ঝুঁকিতে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় গ্রিন ব্যাংকিং খুব দরকার।
দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাংক গ্রিনহাউস ইফেক্ট, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ফলে গ্রিন ব্যাংকিংয়ের ধারণা বা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন ও অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ গ্রিন ব্যাংকিং বাস্তবায়নে কাজ করে। ইউএনইপিএফআই ব্যাংক, বিমাকারী এবং বিনিয়োগকারীদের একটি বৃহৎ নেটওয়ার্ককে একত্রিত করে, যা সম্মিলিতভাবে আরও টেকসই বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য খুবই কার্যকর। ইউএনইপিএফআই ৪৫০টির বেশি সদস্য-ব্যাংক, বিমাকারী এবং বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি আর্থিক খাত তৈরি করতে কাজ করেছে, যা খুব ইতিবাচক।
তবে এর কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। যার উদ্দেশ্য আর্থিক কর্মক্ষমতা এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকিগুলোর সঙ্গে পরিবেশগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রগুলোকে একীভূত করা। এটি নিয়মিত ব্যবসায়িক কার্যক্রম, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য ব্যাংক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে পরিবেশ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিবেশগত সমস্যাগুলো বিবেচনা ও সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।
জলবায়ুর দিক থেকে ভৌগোলিকভাবে একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশে আমরা বসবাস করি। জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় নেওয়া নানা কার্যক্রমের মধ্যে ‘গ্রিন ব্যাংকিং’ অন্যতম। যা বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ‘স্যার জুতা পলিশ করেন, নগদ টাকা দিতে হবে না। কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকাটা আমাকে মোবাইলে দিয়ে দিলেই হবে।
এখন আর খুচরা টাকা নিয়ে ঝামেলা নাই স্যার।’ রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে বসে এভাবেই সেবা নেওয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন শাপলা। এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। তাই সম্পূর্ণভাবে ক্যাশলেস সোসাইটির যুগে আমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এটা করতে পারলে অনেক ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দিতে পারবে না। এর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নেটওয়ার্ক থাকবে, কার কত বিক্রি হয়, যার ওপর বিক্রি কর দিতে হবে।
ই-ব্যাংকিং কার্যকর করতে হবে শতভাগ। যেমন- চীনের ন্যায় উইচ্যাটের মতো একটি সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যাতে সকল লেনদেনের সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ সরকার সহজেই জানতে পারে। দেখা যায়, অনেক দোকানে কার্ডে লেনদেন করতে গেলে তারা নিরুৎসাহী বা অপারগতা প্রকাশ করে। বলে নগদে পেমেন্ট করার জন্য। অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়া বা অবৈধ লেনদেন যাতে হতে পারে। সরকারের কর আয় বৃদ্ধিতে গ্রিন ব্যাংকিং খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো মোট ঋণের ৫ শতাংশ সবুজায়নে বিতরণ করতে পারবে। সব ব্যাংক এটা খরচ করে কি না, তা তদারকি করতে হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে পরিবেশবান্ধব ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ইস্যুতে আরও জোর দেওয়া দরকার।
গ্রিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের অর্থায়ন বৃদ্ধি করবে এবং পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রকল্পের অর্থায়নকে নিরুৎসাহিত করবে। গ্রিন ব্যাংকিং কাগজ এবং কালির সীমিত ব্যবহার, অনলাইন যোগাযোগ বৃদ্ধি, অনলাইন পরিষেবা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে বনসম্পদ রক্ষা করে।
গ্রিন ব্যাংকিং অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, সবুজ অর্থায়ন, জলবায়ু ঝুঁকি তহবিল, সবুজ বিপণন এবং পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। অধিকন্তু গ্রিন ব্যাংকিং বাস্তবায়নে সেক্টরনির্দিষ্ট পরিবেশগত নীতি, সবুজ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কৌশলগত পরিকল্পনা, টেকসই গ্রিন ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রতিবেদনে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উন্নয়ন প্রয়োজন।
অনলাইন ব্যাংকিং সেবার ওপর জোর দিলে কাগজের ব্যবহার কমবে এবং অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। তদুপরি ব্যাংকগুলোকে এমন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে হবে, যা পরিবেশের ক্ষতি না করে। গ্রিন ব্যাংকিংয়ের মূল চাবিকাঠি হলো পরিবেশগত এবং সামাজিক ব্যবসায়িক অনুশীলন প্রদান করা। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব কি-না এবং পৃথিবীতে এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি-না, তা বিবেচনা করতে হবে।
প্রকল্পের অর্থায়নে পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল নীতি ব্যবহার করার এখনই সময়। গ্রিন ব্যাংকিং শিল্পের সবুজায়ন নিশ্চিত করবে। এটি ভবিষ্যতে ব্যাংক সম্পদের মান উন্নত করতেও সাহায্য করবে। গ্রিন ব্যাংকিং ব্যাংকের স্থায়িত্ব নিশ্চিত এবং পরিবেশগত বিপর্যয় মোকাবিলা করে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক গ্রিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে দেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশ দূষিত না করার সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংক শাখার অফিসগুলোকে পরিবেশবান্ধব করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর একটি উদাহরণ হলো শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
গুলশান এভিনিউতে ১৭ তলা করপোরেট হেড অফিস বিল্ডিং তৈরি করেছে, যা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল দ্বারা প্রত্যয়িত ব্যাংকিং সেক্টরের প্রথম গ্রিন বিল্ডিং। ভবনটি ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ এবং পানি সাশ্রয়ী। ভবনের ছাদ গাছ দিয়ে সাজানো। গ্রিন ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিবর্তন করতে এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নিতে সক্ষম করবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজে আসবে। যে নতুন বাংলাদেশ, দেশের জনগণ চাই, সেখানে দুর্নীতিমুক্ত গ্রিন ব্যাংকিং এবং ক্যাশলেস সোসাইটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ