ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

চিরঞ্জীব চিরভাস্বর

খায়রুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৪ আগস্ট ২০২৪

চিরঞ্জীব চিরভাস্বর

.

পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে, প্রতিবাদ করার কারণে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটাতে হয় কারাগারেএকদিন বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছেনবহুদিন পর বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছেকিন্তু ছোট্ট ছেলেটি এই আনন্দের কারণ বুঝতে পারছে নাকেননা, বাড়িতে যে অপরিচিত লোকটি এসেছে, তাকে সে চিনতে পারছে না

আরও অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, এই লোকটিকে তার বড় আপা শেখ হাসিনা আব্বাবলে ডাকছেবেশ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ছেলেটি বড় আপার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘হাসু আপা, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা ডাকি?’ এই ছিলেন শেখ কামালতিনি জাতির পিতার দ্বিতীয় সন্তান এবং বড় ছেলেএকজন দেশপ্রেমিক ও আজন্ম স্বপ্নযোদ্ধাতিনি শুধু স্বপ্ন দেখেননি; স্বপ্ন বাস্তবায়নেও আমৃত্যু কাজ করে গেছেন

আজ ৫ আগস্ট১৯৪৯ সালের এই দিনে শেখ কামালের জন্ম হয়েছিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামেশেখ কামাল কে ছিলেন বা কি ছিলেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেয়ে কী ছিলেন না তিনিএই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা বোধহয় সহজ হবেখুব ছোটবেলা থেকেই সব ধরনের খেলাধুলায় প্রচুর আগ্রহ ছিল তারঢাকার শাহীন স্কুলে থাকাকালীন, ছিলেন স্কুলের প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশএরমধ্যে ক্রিকেটটা তাকে টানত সবচেয়ে বেশিদীর্ঘদেহী পেসার ছিলেননিখুঁত লাইনলেন্থ আর প্রচুর গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকেঅবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেনকিন্তু বাঙালি হওয়ার কারণে এবং মুজিবের পুত্র হওয়ার অপরাধে তার এই প্রতিভা ছিল অবহেলিততিনি উপেক্ষিত হয়েছিলেন নিদারুণভাবেশুধু খেলাধুলাই নয়, পড়াশোনা, সংগীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা- কোথায় নেই শেখ কামাল?

ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগেপড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিম-লে বিস্তৃত হলো তার কর্মপরিধিছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের মেধাবী ছাত্র শেখ কামাল সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা থিয়েটারসুঅভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে সুপরিচিত ছিলেন তিনিএদিকে খেলাধুলাও চলছে পুরোদমেসলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাসিন্দা শেখ কামাল বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেনবাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার হলের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল তার অবস্থানকালীন পুরোটা সময়

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়েকিন্তু শেখ কামালকে কি আর থামানো যায়? বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার সন্তান তিনিনেতৃত্বগুণ আর জাতীয়তাবোধের চেতনা তার ধমনিতে জন্ম থেকেইরবীন্দ্রসংগীতই হলো তার প্রতিবাদের ভাষাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যেখানে যখনই সুযোগ পেলেন, তখনই বিশ্বকবির গান গেয়ে অহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রাখলেন তিনি

শেখ কামাল ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতকর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেনতিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেনশেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেনযুদ্ধকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনস্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে আবার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেনতিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন

মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধু এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্নার সঙ্গে প্রায়ই আলাপ হতো শেখ কামালেরবারবার আশাবাদের সঙ্গে বলতেন- তান্না, দেখে নিস, দেশ স্বাধীন হলে খেলার ছবিটাই বদলে দেব আমিকথা রেখেছিলেন কামালস্বাধীনতার পরে দেশে ফিরেই আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে ১৯৭২ সালে সংস্থার নামে কেনা হলো ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দলক্রিকেট আর হকির দল কেনা হলো ইস্পাহানী স্পোর্টিংয়েরটাএগুলোর সমন্বয়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো আবাহনী ক্রীড়া চক্রনামে ক্লাবের

ফুটবল, ক্রিকেট, হকি  খেলাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন কামালস্বপ্ন দেখতেন একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অঙ্গনে এক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবেআর ফুটবলে তো রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন শেখ কামালদূরদর্শিতা আর আধুনিকতার অপূর্ব সমন্বয়ে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করলেন তিনি গোটা উপমহাদেশেসেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশী কোচ বিল হার্টকে এনে ফুটবলপ্রেমীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেনতখন ক্লাব তো দূরের কথাএই উপমহাদেশে কোনো জাতীয় দলের কোনো বিদেশী কোচ ছিল না১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আইএফএশিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশী কোচ আর পশ্চিমা বেশভূষা দেখে সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকদের চোখ ছানাবড়াহয়ে যায়পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলে আবাহনী ক্রীড়াচক্র দর্শকের অবাক মুগ্ধতা অর্জন করেছিল মাটি কামড়ে ছোট ছোট পাসে মাঠজুড়ে চমকার ফুটবল দিয়েভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন কমল বসুসহ আকাশবাণীর প্রথিতযশা ধারাভাষ্যকাররাশেখ কামাল ফুটবলের মতোই হকিতে নতুন দিনের সূচনা করেছিলেন

যোগ্যতা, দক্ষতা আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ সেই দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফুরণে এই মানুষটা বদলে দিচ্ছিলেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশের পুরো ক্রীড়া ক্ষেত্রশুধু ক্রীড়াই নয়, শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে তিনি পালন করছিলেন অসামান্য অবদানযারা এই দেশকে চায়নি, চায়নি স্বাধীনতা, এই উন্নতি, নতুন দিনের আগমন তাদের কেন সহ্য হবে? জাতির পিতা শেখ মুজিবকে অপবাদ দেওয়ার মতো দুঃসাহস কিংবা বুকের পাটা কখনই হয়নি অন্ধকারের ওই কুসা রটনাকারীদের তাই তারা বেছে নিয়েছিল তার সন্তানদেরএই আগস্টেই তার জন্মআবার এই মাসেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে শহীদ হন১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে তিনি প্রথম শহীদ

শেখ কামালের কর্মময় জীবন চিরদিন আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেবাতাসে ভাসে বঙ্গবন্ধুর মতোই তার তেজোদ্দীপ্ত আওয়াজবঙ্গবন্ধুর ছেলে হয়েও তিনি মন্ত্রী-এমপি হননিতিনি হয়েছিলেন মানুষের বন্ধু, মানবতার প্রতীকভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকেপ্রাণপ্রাচুর্যের কারণে তরুণদের সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন তিনিস্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর তিনি ছিলেন প্রধান সংগঠক

যেখানে স্বাধীনতাউত্তর তরুণ সমাজের সৃজনশীলতা হয়েছিল অবারিততার সহধর্মিণী ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা খুকুবাঙালিসংস্কৃতির চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত ছায়ানটেশেখ কামাল সেতার বাজানো শিখতেনএই গান, খেলাধুলা, অভিনয় আর আড্ডা যার প্রাণ সেই ব্যক্তিই আবার সভা-সমিতি করে মুজিবপন্থি ছাত্রলীগকে সঞ্জীবিত করেছিলেনকিন্তু বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই অপপ্রচার ও মিথ্যাচার রাজনীতিকে দূষিত করে আসছেবঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালই এই মিথ্যাচারের রাজনীতির, অপপ্রচারের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকারতাদের পরিকল্পনা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার মহান নেতা শেখ মুজিবের পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলাএই পরিকল্পনার অংশই ছিল শেখ কামালের বিরুদ্ধে কুসা রটনা করা, তার ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করাকিন্তু সত্য কোনোদিন চাপা থাকে নাসত্যের আলোতে এক সময় মিথ্যার অন্ধকার দূর হয়ে যায়

শেখ কামালের বিচরণ ছিল প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়তার হেঁটে চলা ছিল আবাহনীর মাঠেতিনি ছিলেন আনন্দের প্রতীকখেলাধুলার সঙ্গে যে শিশুরা আজ সম্পৃক্ত এবং যারা আবাহনীর মাঠে দৌড়ে বেড়ায় তাদের সজীবতায় মিশে আছে তার নামযে সবুজ চত্বরে তিনি হেঁটেছেন খোলা পায়ে সেই ঘাসের আদর মেখে এখনকার প্রজন্ম এগিয়ে চলেছেতিনি তো সেই প্রাণের প্রতীক যার নিজকণ্ঠের গান ঘুরেফিরে আসে স্মৃতিকাতর বন্ধুজনের কানেঅন্যদের ভালো কাজে উসাহ দেওয়া তার অন্যতম ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিলজাতির পিতার সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন, একই শার্ট বারবার পরতেন, বিলাস-ব্যসন পরিত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাটক ও গান নিয়ে মেতে থাকতেনশেখ কামালের ২৬ বছরের জীবনে যেমন সৃষ্টির আনন্দ আছে, তেমনি আছে কাঁটার আঘাতওশেখ কামাল অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেনখুনি ঘাতক চক্র শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু এক প্রতিশ্রুতিশীল তারুণ্য বা যুব অহংকারকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছিল ভবিষ্য বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকেঘাতকরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দীপ্ত তারুণ্যের অগ্রদূত এবং ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পথিকৃ, বহুমাত্রিক গুণেগুণান্বিত এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বাঙালির চিন্তা-চেতনায় ও জাতির ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু নর্দমার কীটের হাতে নির্মম ব্রাশফায়ারে শহীদ হওয়ার আগের মাসে বিয়ে হয়েছিল শেখ কামাল আর সুলতানা খুকুররূপকথার মতো অসম্ভব সুন্দর তাদের ভালোবাসার পরিণয় স্থায়ী হয়েছিল মাত্র একমাসবাবা, মা, দুই ভাই এবং স্ত্রী ও অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে শহীদ হওয়ার সময় শেখ কামালের বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছরঅতি ক্ষুদ্র এই জীবনকে তিনি অসামান্য সব কর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন, মাতৃভূমির ইতিহাসের অন্যতম সূর্যসন্তান হিসেবে নিজেকে চিনিয়ে গিয়েছিলেন অসম্ভব বিনয় আর সারল্যে

লেখক : সাংবাদিক, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)

×