সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের নৌকা যাচ্ছে জার্মানিতেÑ এটি একটি সুসংবাদ নিশ্চয়ই। নৌকার জন্য বিখ্যাত বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরের নেছারাবাদের আটঘর। সেই আটঘরের তৈরি ১০টি কাঠের নৌকার প্রথম চালান এবার যাচ্ছে জার্মানিতে। একজন জার্মান নাগরিক নৌকার জন্য সুখ্যাত কারিগর আজিজুল হককে বাংলাদেশে এসে এই অর্ডার দিয়ে গেছেন। আজিজুল হক দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ডিঙ্গি ও টালাই নৌকা তৈরি করছেন দক্ষতার সঙ্গে।
প্রতিটি নৌকার জন্য ১০ হাজার টাকা করে অগ্রিমও দিয়ে গেছেন ওই জার্মান নাগরিক। আগস্টের মাঝামাঝি এসব নৌকা রপ্তানি করা হলে আরও ২০টি নৌকার অর্ডার আসতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি, যেগুলো হবে ভিন্ন ডিজাইন ও নক্সায়। মেহগনি কাঠের তৈরি এসব নৌকা জার্মানিতে কোনো নদী বা লেকে চলাচল করবে না। পরিবর্তে এগুলো ব্যবহার হবে মানুষের জন্য বসার সৌখিন আসন হিসেবে। জার্মানির আসবাবপত্রের দোকানে এসব মার্কেটিং করা হবে।
উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে রংপুরে তৈরি কাঠের বাসগৃহ রপ্তানির খবর পাওয়া গেছে জার্মানিতে। যেগুলো স্থান পেয়েছে সেদেশের বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রে আবাসন হিসেবে। এসবের মাধ্যমে দেশের অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়ছে। স্থানীয় উপজেলা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি ওই নৌকার কারিগরকে সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দায়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবটাতেই নদী ও নৌকার সরব উপস্থিতি ও আনাগোনা। ছোট বড় বিভিন্ন নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে।
এক সময় দেশে যোগাযোগ ছিল নদীকেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা। কালের বিবর্তনে নদীগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক নগর ও বন্দর। গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে। যেমন- ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খি, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রি, সওদাগরি, ইলশা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, বেদে বা সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, বৌচোরা নৌকা, লক্ষ্মীবিলাস, গ-ীবিলাস, খেয়া নৌকা, বাইচের নৌকা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই প্রায় বিলুপ্তির পথে। কতকটা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিছু সংস্করণ সংরক্ষিত রয়েছে বরগুনার নৌকা জাদুঘর এবং জাতীয় জাদুঘরে।
বর্ষাকালে অনেক এলাকায় নৌকা ছাড়া চলাফেরা করা সম্ভব হয় না। তাই পানি আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাঠমিস্ত্রিরা নৌকা তৈরি এবং মেরামতের কাজে ব্যস্ত সময় কাটান। দেশের বিভিন্ন হাটে তাদের তৈরিকৃত নৌকা বিক্রির জন্য নিয়েও আসেন। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তাই নৌকা তৈরি এবং বিক্রির ধুম পড়েছে। কমপক্ষে দুই শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘিওর হাটে নৌকা বিক্রি করে অনেকেরই জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটছে।
সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলা, গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর হাটও ঐতিহ্যবাহী। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এখানেও নৌকার হাট বসে। এই সময় নৌকাই হয়ে ওঠে নদ-নদী, হাওড়পারের মানুষের প্রধান বাহন। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে বাড়তে থাকে নৌকার কদরও। বরিশাল অঞ্চলের মধ্যে নৌকার জন্য বিখ্যাত স্বরূপকাঠী। আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত আটঘর, কুড়িয়ানা ও ইন্দেরহাটে নতুন তৈরি ছোট নৌকা বিক্রির হাট বসে। এছাড়া রূপগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও বসতে দেখা যায় নৌকার হাট। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই নৌকার এখন ঠাঁই হতে চলেছে বিশ্বের উন্নত দেশ জার্মানির গৃহস্থালির আসনে।