ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

সরকার পতনের উদ্দেশ্যেই এমন ঘৃণ্য তান্ডব চালিয়েছে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশিত: ২২:১১, ২৬ জুলাই ২০২৪

সরকার পতনের উদ্দেশ্যেই এমন ঘৃণ্য তান্ডব চালিয়েছে

.

কোনো রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারলে অনেক সময় ক্ষমতার লোভে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সব সময়ই তারা ইস্যু খোঁজার চেষ্টা করে। কোটা সংস্কার ইস্যুতে অনাকাক্সিক্ষত কিছু পরিবেশ সৃষ্টির পর সরকার যখন অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছিল, ঠিক তখনই ওত পেতে থাকা গোষ্ঠী সুযোগ নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ভয়াবহ তান্ড চালায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত মেট্রোরেল, সেতু ভবন, ডেটা সেন্টার, নরসিংদী জেলা কারাগার, টোল প্লাজা, বিটিভিসহ যেসব স্থানে তান্ড চালানো হয়েছে, সেগুলোর সবই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে সেখান থেকে যেসব কয়েদিকে পালিয়ে যেতে তারা সহায়তা করেণ্ডে সেখানে অনেকেই ছিল জঙ্গি।

আর এটা নিশ্চতভাবেই ধারণা করা যায় হামলাকারীরা আগে থেকেই জানত যে সেখানে জঙ্গিরা আটক আছে। তাহলে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, কারা বা কোন্ ধরনের দুর্বৃত্তরা এসব হামলা চালিয়েছে। মূলত যারা সব সময়ই দেশকে অস্থিতিশীল করার কাজে লিপ্ত থাকে, তারাই সুযোগ নিয়েছে- বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী সারাদেশ থেকে গিয়ে রাজধানীর আশপাশে অবস্থান নিয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ঢাকা দখল করা। জামায়াত-বিএনপির দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় না থাকার যে ক্ষোভ এবং অপ্রাপ্তি রয়েছে, সেটির বহির্প্রকাশ হিসেবে তারা চাচ্ছিল যে, কোটা সংস্কার আন্দোলন যেকোনোভাবেই ঘোলাটে হয়ে যাক।

এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু ওইসব কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালীও হয়নি কিংবা সেই অর্থে সফলতাও পায়নি। যেকোনো আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে সফল হতে পারলেই তার ফল ঘরে তোলা যায়। কিন্তু বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে তেমন কোনো সফলতা ঘরে তুলতে পারছে না। রাজনীতিতে ভুল থাকতে পারে। তবে বারবার ভুলে রাজনীতি থেকে সটকে পড়তে হয়। সেটি হতে পারে রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে কিংবা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে। নানা ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা রাজনৈতিক দেওলিয়াত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। কোনো দল রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া না হলে দেশের উন্নয়নের প্রতীকে আঘাত হানতে পারে না। এমনকি সাধারণ জনগণের জানমালের ক্ষতিও করতে পারে না। যেখানে সরকার দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের উন্নয়নে আঘাত হানা এবং জানমালের ক্ষতি করার বিষয়টি দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে।

ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কোটা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হয়েছে। প্রজ্ঞাপনও হয়েছে। মেধাবীদের জন্য ৯৩% চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের সম্মানার্থে তাদের সন্তানদের জন্য % কোটার ব্যবস্থা থাকলেও সেটিও মূলত মেধাবীদের জন্যই প্রযোজ্য হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চাকরিতে আবেদনের উপযুক্ত বয়সী নেই বললেই চলে। ফলে বলা যেতে পারে চূড়ান্তভাবে মেধাবীদের জন্যই ৯৮% চাকরির সুযোগ থাকছে। থেকে স্পষ্ট যে, ছাত্রসমাজের মূল দাবি যথাযথভাবে পূরণ হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তাঁর বিশ্বাস থেকে বলেছিলেন, আন্দোলনকারীরা আদালতের রায়ে হতাশ হবেন না। তাদের পক্ষেই আদালতের রায় যাবে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ভয়াবহ তা-ব। মূলত দেশের উন্নয়নের প্রতীকে আঘাত হেনে দেশবাসীকে আতঙ্কিত করা এবং বিদেশীদের কাছে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। দেশের কেন্দ্রীয় ডেটা সেন্টারে আক্রমণ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষকে বিশ্ব নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এবং বিদেশীদের মোবাইল বা টেলিফোনে ভুল তথ্য প্রেরণ করা। তাদের আক্রমণ দেখে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, মূলত কেপিআই স্থাপনাগুলোতে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হামলা চালিয়েছে। আর ধরনের আক্রমণ করার সামর্থ্য কোনো প্রশিক্ষণ বাহিনী ছাড়া কারও পক্ষে মোটেও সম্ভব না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যেভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই এবারও হামলা চালানো হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের বাঁচানোর জন্য অর্থাৎ আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে কিছু ক্ষেত্রে পাল্টা আক্রমণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়স্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে সরকার সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য বাধ্য হয়ে সশস্ত্র বাহিনী নামিয়েছে। এমনকি কার্ফু দিতে বাধ্য হয়েছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। দেশের পরিস্থিতি কতটা ধ্বংসাত্মক অবস্থায় নিয়ে গেলে একটি গণতান্ত্রিক সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাশা করে- সেটি আমরা সকলেই অনুমান করতে পারি। হাজার হাজার কোটির সম্পদ যেমন বিনষ্ট হয়েছে ওইসব হামলায়, ঠিক তেমনি কার্ফুর কারণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

যখন এমন ভয়াবহ হামলা অগ্নিকান্ডে ঘটনা ঘটে- তখন সেটি দেখে আর কারও বুঝতে বাকি থাকেনি যে, ওই হামলা এবং তান্ড সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে। বিশেষ করে ওই সময়ের পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল যে, একটি মহল চেয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠুক। আর যত সংকটপূর্ণ হবে, ততই সাধারণ জনগণকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানো সম্ভব হবে। খুব স্বাভাবিকভাবে কোনো সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে, সেই সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আর প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টি অনেকটা আপেক্ষিক। যত ভাবেই প্রত্যাশা পূরণ করা যাক না কেন, মানুষের চাহিদার শেষ থাকে না। আর এই সুযোগে সাধারণ জনগণকেও সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন সহজ হয়।

বাংলাদেশকে যেকোনোভাবেই অনিরাপদ প্রমাণ করতেই মরিয়া রয়েছে একটি কুচক্রী মহল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের অন্যতম নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অনেক সময় নিরাপত্তার শঙ্কা হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে প্রতিনিয়ত সরকারকে বিপাকে ফেলার টার্গেট নিয়ে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। তাতে যদি সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্নও হয়, তাতে তাদের মাথাব্যথা থাকে না। এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতাই অধিকভাবে লক্ষ্য করা যায়।

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

×