ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

কোটা ইস্যুর যৌক্তিক সমাধান

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২২:০৫, ২৬ জুলাই ২০২৪

কোটা ইস্যুর যৌক্তিক সমাধান

.

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ রহিত) করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে বলা হয়, কোটা নির্ধারণ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়। তবু সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের এখতিয়ারবলে এবং সার্বিক যৌক্তিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮(), ২৯() ২৯() অনুচ্ছেদে থাকা সমতার নীতি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতের প্রতি লক্ষ্য রেখে কোটা নির্ধারণ করেছেন আদালত।

রায়ে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী তৃতীয় লিঙ্গের জন্য শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর দেশের সর্বমহলে রায়টিকে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌক্তিক বিচক্ষণ রায় হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। হলফ করে বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য নির্ধারিত শতাংশ কোটা সরকারি চাকরিতে বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ (চাকরি প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সংখ্যা একেবারেই কম), সেক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ শতকরা ৯৭-৯৮ ভাগ হয়ে যাবে। কেননা, বলা হয়েছে, কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ কোটা নির্ধারণ নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ের পর বলেন, ‘রায়ে আদালত কোটা নিয়ে একটি মাপকাঠি দিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় আদালতের রায় যৌক্তিক, সমস্যা সমাধানে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে সম্প্রতি আদালতের রায়ের বিষয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেন; ‘আদালত কিন্তু আগেই একটা স্থিতাবস্থা দিয়েছেন।...এটি হয়তো চাপা পড়ে গেছে বা ওইভাবে সামনে আসেনি। জোরালোভাবে সামনে না আনার কারণে বা বোধগম্য না হওয়ার কারণে মাঝখানে এতটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেল। যেটা কারও কাম্য নয় অর্থাৎ আদালত যেহেতু একটি স্থিতাবস্থা দিয়েছিল, সেহেতু আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত অবধি সকল পক্ষকেই শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখা উচিত ছিল। কোটা আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যারা সহিংস আন্দোলনে রূপ দিয়েছে, তাদের কারণেই অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে এবং রাষ্ট্রের সম্পদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাসান আরিফ তাঁর বক্তব্যে আরও তুলে ধরেন; ‘মুক্তিযুদ্ধ সব আলোচনার ঊর্ধ্বে, বিতর্কের ঊর্ধ্বে। মুক্তিযুদ্ধের ফলেই এই দেশ, এই সংবিধান; আর সংবিধানের কারণেই আদালত, যেখানে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আইন নিয়ে আলোচনা হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধকে বিচার করার জন্য নয়

প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণার সময় বলেন, ‘গত ১০ জুলাই প্রদত্ত এক আদেশে এই আদালত হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছিল এবং এর (হাইকোর্টের রায়ের) কার্যক্রম স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। এই অন্তর্বর্তী আদেশের ফলে ২০১৮ সালে সরকারের কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু এই আদেশটির অর্থ আমাদের শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে, ঝরে গেছে অনেক প্রাণ, যা মোটেই কাম্য ছিল না রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ বলেন, ‘এই বিষয়গুলো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তাদের চিন্তায়, মননে, স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। তবেই পথ হারাবে না বাংলাদেশ। টিকে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত আমাদের এই মাতৃভূমি। এর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকব আমরা, বেঁচে থাকবে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা। তাঁদের প্রতি কোনো রকম অসম্মান অবশ্যই জাতি ভালোভাবে নেয় না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে যাতে কখনো কার্পণ্য না হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে

আদালতের রায়ের পর কোটা নির্ধারণ সরকারি চাকরির কোন্ কোন্ গ্রেডের জন্য হয়েছে এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। ২০১৮ সালের পরিপত্রে বলা হয়েছিল ১ম ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোটা থাকবে না। এর  পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন; আদালত সুনির্দিষ্ট করে কোনো গ্রেডের কথা বলেননি। ফলে, ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ সরকারি চাকরির সব গ্রেডের ক্ষেত্রেই মেধাভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে। নারী কোটা না থাকার বিষয়ে মন্ত্রী জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারীরাই বলেছেন তারা (নারী) অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন। তার কারণ হচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী এবং অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। সে জন্য ক্ষমতা তাদের অনেক।

আন্দোলনকারীদের এটিও দাবি ছিল। এখন আদালত যদি আন্দোলনকারীদের দাবিটি বিবেচনায় করে থাকেন, তাহলে তার কিছু বলার নেই। এদিকে আদালতের রায় এবং সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর নারী কোটার বিষয়ে আলোচনা উত্থাপিত হচ্ছে, বিশিষ্টজনেরা নারী কোটার পক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কোটা আন্দোলনের অগ্রভাগে নারী শিক্ষার্থীরাও ছিলেন, তারা নিজেরা বলেছেন, তারা সমঅধিকারে বিশ্বাসী। কোটার সুবিধা নিতে তারা আগ্রহী নন। বর্তমানের নারী শিক্ষার্থীরা আগামীতে সরকারি চাকরিতে যোগদান করবেন। আগামীতে যারা যোগদান করবেন তারা নিজেরা যখন কোটা সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী নন, কাজেই তাদের জন্য কোটা রাখার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। কেননা, মেয়েরা নিজেদের অনগ্রসর মনে করছে না, মেধার যোগ্যতায় তারা চাকরিতে অংশগ্রহণ করবেন- তাদের ইচ্ছাটি আদালত বিবেচনায় নিয়ে গ্রহণ করেছে। সুতরাং নারী কোটা নিয়ে দাবি উত্থাপনের যৌক্তিকতা এখন আর নেই। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে যখন দেখা যাবে নারীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, সমতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন নারী শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে কিংবা সরকার নিজ দায়িত্বে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।  

আদালতের শুনানিতে অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমির বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। অথচ যে ইস্যু সামনে, তা মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানের বিষয়ে নয়। ইস্যু হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি, নাতির নাতি নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে যাদের জন্ম হয়নি, তারা কিভাবে অনগ্রসর? মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর গোষ্ঠী নন, তাঁরা অগ্রগামী সৈনিক। তাঁরা আমাদের গর্ব।

মুক্তিযোদ্ধা যদি অনগ্রসর না হন, তাহলে তাদের নাতি-পুতি কিভাবে অনগ্রসর হবেন? রিটটি গ্রহণযোগ্য নয় জনাকীর্ণ আদালতে সকল পক্ষের যুক্তি তর্ক শুনে বিজ্ঞ আদালত সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে রায় প্রদান করেন। আদালতে যারা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন, প্রত্যেকেই কোটা নিয়ে আদালতের রায়ের বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আশা করা যায়, শিক্ষার্থীরাও আদালতের এই রায়কে সম্মান জানিয়ে ক্লাসে ফিরে যাবেন। আদালতও প্রত্যাশা করেছেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আদালতের রায়ের প্রতি সম্মতি জানিয়ে শ্রেণিকক্ষে ফেরত যাবেন। আদালত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনতিবিলম্বে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। সরকারের প্রতি আদালত আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে। ইত্যবসরে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রত্যেকটি ছাত্রের মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবে সরকার- আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে এমনটি প্রত্যাশা করে।

আলোচনা পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় আদালত যে রায় প্রদান করেছেন, সেটি যৌক্তিক এবং উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য যুতসই। কাজেই আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে শিক্ষার্থীদের উচিত হবে শ্রেণিকক্ষে ফেরত যাওয়া। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কতিপয় গোষ্ঠী প্রতারকচক্রের ইন্ধন পরিলক্ষিত হয়েছিল, যারা মহান মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেনি। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আজকের মর্যাদার স্বাধীন বাংলাদেশ। তাঁদের কোনোভাবেই খাটো করা যাবে না, ঘুণাক্ষরেও কটাক্ষ করা যাবে না। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেছে, তারা রাষ্ট্র গঠনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করবে এমনটি সকলের প্রত্যাশা। তবে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে যারা সংঘর্ষে রূপদান করেছে, রাষ্ট্রীয় স্থাপনা সম্পদ নষ্ট করেছে; তাদের যথাযথ প্রমাণ তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণ আদায় আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা স্থিতি ফিরিয়ে আনতে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা করবে সাধারণ জনগণের এমনটিই প্রত্যাশা।   

লেখক : সহকারী অধ্যাপক সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×