ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বাহরাইন- রেমিটেন্স আহরণের দেশ

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২৫ জুলাই ২০২৪

বাহরাইন- রেমিটেন্স আহরণের দেশ

দলিল এক্সচেঞ্জ কোম্পানির সঙ্গে রেমিটেন্স এ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি

পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন সবচেয়ে ছোট্ট একটি রাষ্ট্র। লোকসংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। তন্মধ্যে ৪০% প্রবাসী শ্রমিক। আবার এ সকল প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ভারতের কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এর পরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও জানা গেছে, দুই লাখের কাছাকাছি প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক বাহরাইনে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তন্মধ্যে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি।

দেশটিতে প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের এতটাই সুযোগ রয়েছে যে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অতটা ধারণা নেই বললেই চলে। মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির বাজার বলতে তারা শুধু সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত এসব দেশকেই বেশি বুঝে। সরকারি পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাহরাইনে আরও জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগানো বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।
বাহরাইনের সকল কর্মক্ষেত্রেই ভারতীয়রা একচেটিয়া বাজার দখল করে আছে। কারণ, তাদের বেশিরভাগ লোকই দক্ষ এবং শিক্ষিত। তুলনামূলকভাবে যারা কম শিক্ষিত, তারাও ভালো ইংরেজি বলতে পারে। ফলে, চাকরির ক্ষেত্রে তারাই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। প্রবাসী শ্রমিকদের কাজ তদারকির জন্য বাহরাইনিরা সাধারণত সুপারভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তাইতো যোগ্যতা অনুসারে ইন্ডিয়ান লোকগুলোই এ পদে বেশি নিয়োগ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশী শ্রমিকের কাজগুলো সাধারণত তারাই তদারকি করে থাকেন।
বাহরাইনে কর্মরত বেশিরভাগ বাংলাদেশী শ্রমিক অদক্ষ বা আধাদক্ষ বলে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না। ইন্ডিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া এমনকি নেপালের থেকেও পিছিয়ে রয়েছে। ফলে, কনস্ট্রাকশনের কাজেই তারা বেশি নিয়োজিত। এতে যেমন রয়েছে হাড়ভাঙা খাটুনি, তেমনি বেতন-ভাতাও তুলনামূলকভাবে কম। ওদেশের আকাশছোঁয়া নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে ব্যস্ত হলুদ বর্ণের পোশাক পরা পরিশ্রমী মুখগুলো দেখলেই বোঝা যায় এরা বাংলাদেশী শ্রমিক। বহু শ্রমিক রয়েছে যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবার এমন বহু বিদেশী কর্মী রয়েছে, যারা আকর্ষণীয় বেতন-ভাতায় কাজ করছে। অর্থাৎ জীবনযাত্রার মানে রয়েছে এক বিশাল তারতম্য।
দেশটিতে খাওয়াদাওয়ার পেছনে অতটা ব্যয় না হলেও থাকার জন্য খরচটা একটু বেশিই পড়ে। তাইতো কয়েকজন একত্রে মিলে গাদাগাদি করে বসবাস করে। মাসের খরচ বাদ দিয়ে যা বাঁচে, দেশে পরিবার-পরিজনের নিকট পাঠিয়ে দেয়। তাদর এ কষ্টের জীবন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় দেশেই অদক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের অসৎ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর শোষণের চিত্র। 
বাহরাইনে কর্মরত লোকগুলো কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও ঢাকার দোহার অঞ্চল থেকেই বেশি এসেছে। কনস্ট্রাকশনের কাজ ছাড়াও অনেকে বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। দেশে কৃষি কাজে যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারা ও’দেশের সবজি বাগানে কাজ করে। আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের সবজি যেমন ফুলকপি, পেঁপে, করল্লা, বেগুন, ঝিংগা, শশা, টমেটো উৎপাদন করে থাকে। চাষবাসের পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক বিধায় এদেশের সবজি  দেখার মতো।

মরুভূমির দেশেও সতেজ সবুজ টাটকা সবজির ফলন দেখে বিমোহিত হয়েছি। আর আমাদের দেশের লোকেরাই তা সুদূর বাহরাইনে কৃত্রিম মাটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদন করছে। যে লোকগুলো নিজের দেশে অভাবের তাড়নায় পেটপুরে দুমুঠো ভাত খেতে পায়নি এবং অন্যরা যাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছে, সেই লোকগুলোই তাদের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে সোনা ফলাচ্ছে। বাহরাইনে হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে গ্রিন সালাদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। খাবারের তালিকায় পর্যটকদের কাছে গ্রিন সালাদ একটি আকর্ষণীয় আইটেম। 
বাহরাইন মরুভূমির দেশ হলেও গাছপালার অভাব নেই। কৃত্রিমভাবে ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়েছে। অনেক খরচের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে ভারতের কেরালা থেকে উন্নতমানের মাটি এনে মরুভূমির উপরে বালির স্তরকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আর এ কৃত্রিম মাটির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর সাজানো শহর বাহরাইন। রাস্তার দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে কৃত্রিম উপায়ে রোপণকৃত সবুজ গাছপালা, হরেকরকম বাহারি বাগান ও শত শত খেজুরের গাছ দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, এ দেশটি মরুভূমির দেশ। এ মরুদেশটিকে সবুজ করার পেছনে বাংলাদেশী শ্রমিকের অবদান অনস্বীকার্য। তাইতো প্রতিটি বৃক্ষের মূলে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশী শ্রমিকের ঘামের গন্ধ।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে বাহরাইনের পোয়াবারো। আর তখন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি জনশক্তি আমদানিও বাড়িয়ে দেয়। দেশটির দালানকোঠা, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে আরম্ভ করে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়াসহ সকল কাজের জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। আর নিজেরা বেশিরভাগ সময় আমোদ-ফুর্তি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। শ্রমিকদের তারা সবসময় অবজ্ঞার চোখে দেখে।

এ গরমের দেশে বাংলাদেশ থেকে আগত বেশিরভাগ শ্রমিক ধুলাবালি, কাদামাটিতে কাজ করে। এতে তাদের গায়ে ঘামের গন্ধ হয়। ফলে, বাহরাইনিরা তাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে চায় না। কোনো কারণে এলেও দুর্গন্ধ এড়াতে পারফিউম ব্যবহার করে।  আর এজন্যই ওদেশের সুপার স্টোরগুলোতে ঢুকলেই গ্লাসের ভেতরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ধরনের প্রচুর পারফিউম চোখে পড়ে। 
বাহরাইনে শিল্প-কলকারখানার প্রসার ঘটলেও গার্মেন্টস শিল্পের তেমন একটা প্রসার ঘটেনি। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। তন্মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী ভাইবোনদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে ‘কিমিয়া গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি’ যা রাজধানী শহর মানামা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ গার্মেন্টস শিল্পটিতে প্রায় এক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী ভাইবোনেরা মিলেমিশে কাজ করছে। একদিন তাদের ফ্যাক্টরি দেখার সুযোগও ঘটে গেল।

ম্যানেজিং ডাইরেক্টর  সুলতান মাহমুদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, বাহরাইনের বর্তমান কিং শেখ হামাদ ওদেশে শিল্প-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটানোর জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন। আমেরিকার ওয়ালমার্ট ও টার্গেট গ্রুপ তাদের মূল বায়ার। কথা বলতে বলতে মাহমুদ যখন সব ফ্লোর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন বাংলাদেশের কোনো উন্নতমানের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি পরিদর্শন করছি।
এই সুদূর বাহরাইনে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ওয়ার্কারদের প্রতি যে কতটা আন্তরিক ও যতœশীল তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তাদের থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াতসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি দেশে আত্মীয়স্বজনের নিকট রেমিটেন্স প্রেরণে যাতে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা বা হয়রানির শিকার না হতে হয়, তার জন্য স্থানীয় এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রেমিটেন্স অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, দেশে রেমিটেন্স প্রেরণ করার লক্ষ্যে ওয়ার্কারদের ২৫ মাইল দূরে মানামা সিটিতে গিয়ে কোনো এক্সচেঞ্জ কোম্পানির নিকট ধরনা দিতে হচ্ছে না।

এক্সচেঞ্জ কোম্পানির লোকেরাই কিমিয়া গার্মেন্টসে এসে রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুটোই বাঁচছে। জনাব সুলতান মাহমুদ ও তার অপরাপর সহযোগী সুদূর বাহরাইনে কিমিয়া গার্মেন্টসের  মতো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রবাসী বাংলাদেশী ভাইবোনদের জন্য যে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন, তা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটির উত্তরোত্তর সফলতা ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।

বাহরাইনে কর্মরত ওভারসিজ ওয়ার্কারদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণের লক্ষ্যে স্থানীয় অধিবাসী বাহরাইনিদের ব্যক্তিমালিকানায় অনেক মানি ট্রান্সফার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে জেন্ড এক্সচেঞ্জ, দলিল এক্সচেঞ্জ, বাহরাইন ফাইন্যান্স কোম্পানি অন্যতম। সোনালী ব্যাংকের একটি অন্যতম বৃহৎ কর্পোরেট শাখায় কাজ করার সময় জেন্ড এক্সচেঞ্জ কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আলী হামদ আবুলের সঙ্গে পরিচয় হয়।

পরবর্তীতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের রেমিটেন্স বিজনেস সম্প্রসারণের কাজে বাহরাইনে গেলে আলী হামদ আবুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আর তখনই জেন্ড এক্সচেঞ্জ কোম্পানির সফলতার কথা জানতে পারি। বাহরাইনে আলী হামদ আবুলের উষ্ণ আতিথেয়তা অনেকদিন মনে থাকবে।
বাহরাইনে বাংলাদেশের জন্য একটি চমৎকার জনশক্তির বাজার গড়ে উঠেছে। দেশটিতে প্রাচুর্যের অভাব নেই বিধায় রাস্তাঘাট, দালানকোঠা নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকা- প্রতিদিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের দ্রুত প্রসার ঘটছে। জনশক্তি রপ্তানির এ সম্ভাবনায় বাজারের প্রতি আমাদের আরও যতœশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশটি অদক্ষ শ্রমশক্তিতে ভরপুর। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বেশি হলেও আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখনো তেমন কোনো জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার উপযোগী মানের প্রশিক্ষণদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। যতটুকু আছে তা এই বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তির জন্য নিতান্তই অপর্যাপ্ত।

কাজেই কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যারা বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছেন, যাওয়ার আগে যে কোনো একটি বিষয়ে দক্ষ হয়ে গেলে একদিকে যেমন দ্রুত চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, অন্যদিকে ভালো বেতন পাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটা জানা থাকলে তো কথাই নেই।
কাজেই বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার কথা বিবেচনায় রেখে শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত বেকারদের যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে সরকারি ও বেরকারি ব্যবস্থাপনায় জনশক্তি রপ্তানির সুবন্দোবস্ত করতে পারলে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ

×