ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

ইন্টারনেট বিপর্যয় ও দেশের অর্থনীতি

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৫ জুলাই ২০২৪

ইন্টারনেট বিপর্যয় ও দেশের অর্থনীতি

ইন্টারনেট শব্দটি আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দের একটি

ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে অনলাইনভিত্তিক  সব ধরনের লেনদেন। অ্যাপনির্ভর ব্যাংকিং সেবা মুঠোফোন আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মুঠোফোনে রিচার্জের জন্য মানুষ টাকা নিয়ে দোকানে দোকানে যাচ্ছেন, কিন্তু রিচার্জ করতে পারছেন না। ভেবে দেখুন, মুমূর্ষু মা-বাবার চেহারাটি শেষবারের জন্য দেখার সংবাদটিও পৌঁছানো যাচ্ছে না। মুঠোফোনে ব্যালেন্স না থাকার কারণে এই অবস্থা দীর্ঘসময় চলতে পারে  না। আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করে আদিম মানুষের মতো জীবনযাপন করা কোনোভাবেই 
সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়

ইন্টারনেট শব্দটি আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দের একটি। শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই এর কারণ উপলব্ধি করা যায়। ইন্টার অর্থ আন্ত এবং নেট অর্থ জাল। মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে রাখা যোগাযোগের অস্পর্শনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা মানব সভ্যতাকে এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। মানুষের জীবনকে সবদিক দিয়েই উন্নততর এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনকে এক লহমায় বদলে দেওয়া ‘ইন্টারনেট’ ব্যবস্থাটি থেকে বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির বাংলাদেশ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রয়েছে কিছুদিন।

এর ফলে বাংলাদেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে- শতাব্দীর ভয়াবহতম ভাইরাস কোভিড-১৯ এর সময়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি  এ রকমভাবে থমকে যায়নি। কারণ, ইন্টারনেট না থাকায় ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, বিদ্যুৎ, ও গ্যাস বিল, অনলাইনে টাকা লেনদেন, মুঠোফোনে টাকা ভরা, অনলাইনে কেনাবেচা, ফ্রিল্যান্সিং, বিমান ও যোগাযোগ পরিষেবার টিকিট কেনা, অনলাইনভিত্তিক বিনোদনের মাধ্যম (ওটিটি, ইউটিউব, ফেসবুক), সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবধরনের সেবাই বন্ধ হয়ে গেছে। 
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এভাবে থমকে যাবে, বিপর্যস্ত হবে, তা কারও কল্পনায়ও ছিল না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে দীর্ঘসময় ধরে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা অনুষঙ্গে দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এখন আবার সহজেই সমাধানযোগ্য একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে তুঘলকি কা-ে অর্থনীতিতে  পুরোপুরি বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমদানি-রপ্তানি বিঘিœত হওয়ায় ভেঙে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

আমরা জানি, কোভিড-১৯ অভিঘাত সামলে ওঠার সময়ই বিশ্বজুড়ে নতুন সংকট সৃষ্টি করে ইউরোপের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে ইসরাইলের ভয়াবহ আক্রমণ শুরু হয়। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও আক্রান্ত করে। লোহিত সাগর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত পোশাক রপ্তানি কমে যায়। রেমিটেন্স প্রবাহেও দেখা দেয় ভাটার টান।

এমন এক অবস্থায় কোটা আন্দোলনকে  ঘিরে আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থার মেরুদ- ইন্টারনেটের বিপর্যয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বলা যায় এক অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নেমে এসেছে প্রায় স্থবিরতা। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে ব্যবসায়ীদের সংকটে পড়তে হচ্ছে। সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা দুঃসাধ্য।

কেননা, মানুষের জীবন রক্ষাকারী  চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে জীবন রক্ষার জন্য জরুরি সেবা আহ্বানকারী মুঠোফোনও ইন্টারনেটের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তবু বলা যায়, বাংলাদেশ ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি দৈনিক ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ, ইন্টারনেট না থাকা মানে অফিস-আদালত না থাকা।  
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে অনলাইনভিত্তিক  সব ধরনের লেনদেন। অ্যাপনির্ভর ব্যাংকিং সেবা, মুঠোফোন আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের সবধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মুঠোফোনে রিচার্জের জন্য মানুষ টাকা নিয়ে দোকানে দোকানে যাচ্ছেন, কিন্তু রিচার্জ করতে পারছেন না। ভেবে দেখুন, মুমূর্ষু মা-বাবার চেহারাটি শেষবারের জন্য দেখার সংবাদটিও পৌঁছানো যাচ্ছে না মুঠোফোনে ব্যালেন্স না থাকার কারণে। এই অবস্থা দীর্ঘসময় চলতে পারে  না। আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করে আদিম মানুষের মতো জীবনযাপন করা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করা হবে। সীমিত পরিমাণে হয়েছেও। তবে ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক ও যোগাযোগের অ্যাপ বন্ধ এখনো। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবমুখী, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম ভরসা হয়ে ওঠা ফ্রিল্যান্সিং খাতের জন্য এসব মাধ্যম প্রয়োজনীয়। এসব মাধ্যম ‘গুজব’ ছড়ানোর হাতিয়ার, এটা ঠিক। কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে রাখাও অনভিপ্রেত।

সাময়িকভাবে এসব বন্ধ করা হলেও দ্রুত তা উন্মুক্ত করে দেওয়া সমীচীন হবে। কেননা, ইন্টারনেট জাতিসংঘ স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইন্টারনেট চালু রেখে সত্য ও গ্রহণযোগ্য সংবাদ প্রচার করলে এবং যার যার অবস্থান থেকে সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিলে, বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই সরকারের সহযোগী ভূমিকায় অংশ নেবে।
পরিশেষে বলব, নানাভাবে সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে সব পক্ষের শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হওয়ার পর সব পক্ষকে দেশপ্রেমিকের ভূমিকা নিয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধভাবে পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করতে হবে। 
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক 
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×