ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

প্রসঙ্গ ইসলাম

শাহাদাতে কারবালা ॥ নবী পরিবারের সময়োপযোগী আত্মত্যাগ

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২৫ জুলাই ২০২৪

শাহাদাতে কারবালা ॥ নবী পরিবারের সময়োপযোগী আত্মত্যাগ

প্রসঙ্গ ইসলাম

অনেক ঘটনা মহা ঘটনার মধ্যে উম্মতে মুহাম্মদীর কাছে  আশুরা দিনটি আরও একটি বিশেষ কারণে অবিস্মরণীয়। ৬১ হিজরির এই দিনে নুরনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হযরত আলী-ফাতিমা (রা.) এর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইন (রা.) এবং নবী পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ ও সদস্য কারবালা প্রান্তরে এজিদ বাহিনীর হাতে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ হৃদয় বিদারক ঘটনা আশুরাকে দান করেছে এক নতুন তাৎপর্য। বস্তুত কারবালার ঘটনাটি ছিল হক ও বাতিলের সংঘাত। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের মিশন ছিল বাতিল আর মিথ্যার উপর সত্যের দাওয়াতকে বুলন্দ করা।

আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের পর এর দায়িত্ব বর্তায় তার যোগ্য উত্তরসূরীদের ওপর। খোলাফায়ে রাশেদীন এ দায়িত্বের আঞ্জাম দেন। তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রবর্তিত মহানবীর (সা.) শরীয়তকে সব ধরনের বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেন। তাদের তিরোধানের পর এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রকারী ইসলামী শরীয়তকে বিকৃত করতে থাকে, তারা নিষ্কলুষ শরীয়ত ও খিলাফতকে গোত্রীয় বন্দীশালায় আবদ্ধ করে ফেলতে চায়। যার পরিণতিতে উদ্ভূত হয়েছিল কারবালার ঘটনা। ইমাম হুসাইন (রা.) এর একটি ভাষণ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার ভাষায়-
‘যে ইসলামী পন্থাকে অবনমিত করেছে, হয়েছে প্রমোদ বিহারী, যার দরবারে স্বাধীনতা নেই, যে অবৈধকে বৈধ করেছে এবং দুর্বল-দারিদ্র্যের জীবনযাত্রা দোজখের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে আমি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে প্রস্তুত নই...।’ তাই তিনি জালিমের রক্ত চক্ষুকে আর ভয় না করে নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের দিকে মনোনিবেশ করেন। আসলে সেদিন তিনি যদি অন্যায় কাজে সামান্যতমও আপোস করতেন তাহলে ইতিহাস হতো আজ অন্য রকম।

কিন্তু ইমাম হুসাইন ৭২ জন সঙ্গীসাথীসহ শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে মুসলমান ও দুনিয়াবাসীর সামনে দেখিয়ে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রকৃত ভাষা ও যুগ সন্ধিক্ষণে বীর পুরুষদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত।
ইতিহাস বলছে, ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে আমীরে মুয়াবিয়া তার অযোগ্য পুত্র দুরাচারী এজিদকে খেলাফতের মতো পবিত্র মসনদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খেলাফত গ্রহণ করলে গোটা উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয়। উপরন্তু ইয়াজিদ সে যুগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইমাম ও ব্যক্তিত্ব হুসাইন (রা.) কে তার হাতে বায়াত হতে নির্দেশ দেন।

আল্লাহর রাসুলের প্রিয় দৌহিত্র অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এজিদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে  তোলেন। এদিকে কুফাবাসী সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে তাকে সেখানে আগমনের অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে ইমাম হুসাইন (রা.) যখন কুফার উপকণ্ঠে পৌঁছেন তখন দেখা গেল সাহায্যের আশ্বাসদাতা কুফাবাসীগণ তাদের প্রস্তাব থেকে সরে যায়। 
অগত্যা নিরুপায় হয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) যখন তার স্বল্প সংখ্যক বন্ধু ও সমর্থক নিয়ে ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালায় পৌঁছেন তখন ইয়াজিদ বাহিনীর সদস্য ওমর ইবনে সাদ, ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ তার গতিরোধ করে এবং তাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। মহান ইমাম পবিত্র ইসলাম ও নানাজি হযরত মুহাম্মদের আদর্শের পরিপন্থি কোনো কর্মকা-ে সাড়া দিতে পারেন না।

এক পর্যায়ে  ইয়াজিদ বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালাতে থাকলে তারা মৃত্যুকে পরওয়া না করে ইয়াজিদ বাহিনীর সঙ্গে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধ করে যান। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর এজিদ সেনারা ইমাম হুসাইনের সঙ্গী সাথী ও পরিবার পরিজনের শিবিরে ফোরাতের পানি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে গোটা শিবিরে হাহাকার পড়ে যায়। এ যুদ্ধে ভ্রাতুস্পুত্র কাশেম প্রথম শাহাদাত বরণ করেন। পরে একে একে ৭২ জন শহীদ হন।

তারপর পিপাসার্ত ইমাম হুসাইন পুত্র আসগরকে নিয়ে ফুরাতে পানি পান করতে গেলে দু’জনেই তীরবিদ্ধ হন। একটি শরের আঘাতে ইমামের বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। নরপিশাচ সীমার তার শিরñেদ করতে উদ্যত হলে অবশেষে যন্ত্রণাকাতর  ইমাম হুসাইনের নির্দেশে তার ঘাড়ের ওপর তরবারি চালিয়ে পবিত্র মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয়। খুনিরা এ উন্মাদনা উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৃশংসতা দেখিয়ে শুধু উল্লসিতই হয়নি বরং শহীদদের মাথা মোবারাকগুলোর সঙ্গে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ঊনিশটির মতো মস্তক এজিদের রাজদরবারে নিয়ে কৃতিত্ব প্রদর্শন করছিল।

হযরত উম্মে সালমা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি একদা শুয়ে ছিলাম। তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি আমার প্রিয় হযরত (সা.) আমার সামনে দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত বিধ্বস্ত বদনে তাকে আর কখনো দেখিনি। চুলগুলো উশকো খুশকো, আর তার দাড়ি মুবারকে ধুলোবালি লেগে আছে। আমি কান্নাভরে জানতে চাইলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন? হুজুর অস্থির স্বরে বললেন: উম্মে সালমা: তুমি কী জানো না? আজ কারবালা প্রান্তরে আমার প্রিয় দৌহিত্র হুসাইনকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে।

আমি তার শাহাদাতের জমিনে উপস্থিত ছিলাম। আমার হুসাইন ও অন্যদের কাতরানির মধ্যে আমিও গড়াগড়ি করেছি ...। ( মদিনায় যেদিন এ স্বপ্ন দেখেছেন উম্মে সালমা সেদিন ছিল ১০ই মুহরম ৬১ হিজরি, আর নবীজীকে কেউ স্বপ্ন দেখলে তা বাস্তবিকে দেখার মতো)।
ইমাম হুসাইন (রা.) কে যেরূপ নির্মম বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয় মানব ইতিহাসে সে রকম ঘটনা খুব বেশি নেই। তেমনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি যেরূপ সাহসিকতা, নির্ভীকতা ত্যাগ ও নিষ্ঠার নজির তুলে ধরেন তাও দুর্লভ। ইমাম হুসাইনের এ মর্মন্তুদ পরিণতি সারা বিশ্বের মুসলমানকে শোকে দুঃখে আজও মুহ্যমান করে তোলে এবং সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে মহত্ত্বর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। তাই মুহরম ও আশুরার ঘটনাবলী বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে ইমানি তেজোদ্দীপনার এক অনির্বাণ শিখা। 

ইতিহাসের দেদার ঘটনার সাক্ষী মুহরম ও আশুরার শিক্ষা অফুরন্ত ও অলংঘনীয়। তবে এক্ষেত্রে কারবালার ঘটনা ও শিক্ষা মুসলমানদের ব্যাপকভাবে উদ্বেলিত ও আন্দোলিত করে। মুসলমানদের জীবন চলার পথে, বাঁকে বাঁকে ইসলাম বিদ্বেষীদের সঙ্গে সংগ্রামে শাহাদাতে কারবালা এক অপরিমেয় শক্তির উৎস। এর ঐতিহাসিক প্রমাণ হলো, এজিদি শক্তি, যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম ও নবী বংশের মূল স্রোতধারায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। মাত্র ৬০ বছরের ব্যবধানে এজিদি রাজতন্ত্র ও উমাইয়া শাসন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এর পেছনে ছিল সম্মিলিত মুসলিম উম্মাহর ঘৃণা, ক্ষোভ ও রক্তঝরা আন্দোলন। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×