ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতি

শাকিল আহামেদ

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২৪ জুলাই ২০২৪

সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতি

সমুদ্র সম্পদ- যাকে আমরা বলি ব্লু-ওশান ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি

সমুদ্র সম্পদ- যাকে আমরা বলি ব্লু-ওশান ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি। বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণার জন্ম দেন। ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ কাজে লাগানোর অর্থনীতি হচ্ছে এটি। সমুদ্র থেকে আহরণকৃত যে কোনো সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে তাই ব্লু-ইকোনমির আওতায় পড়বে।

জাতিসংঘ ব্লু-ইকোনমিকে মহাসাগর, সমুদ্র ও উপকূলীয় সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের একটি পরিসর হিসেবে উল্লেখ করে। সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি করা সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারসাম্য সৃষ্টি করা।
ব্লু-ইকোনমি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। বিগত বছরগুলোতে যত আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে, তার প্রায় সবই ব্লু-ইকোনমি আলোচনার কেন্দ্রে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। প্রতিবছর ২ কোটি ৩০ লাখ টন অনুমোদিত টেকসই সামুদ্রিক খাদ্য ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলারে বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের ১৪ শতাংশ। বিশ্বে ১০-১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে  জীবিকার জন্য সামুদ্রিক খাদ্যশিল্পের ওপর নির্ভরশীল।

পৃথিবীর ৩০ শতাংশ গ্যাস  ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের  গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বাণিজ্যিক পরিবহনের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ইউরোপের  উপকূলীয় দেশগুলোর নীল অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর বিলিয়ন ইউরো আয় করতে পারে, যা তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। প্রতিবছর সমুদ্রপথে ১৫০টির বেশি দেশের প্রায় ৫০ হাজারের ওপর বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। 
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া বর্তমান সময়ে জিডিপিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। গত পাঁচ বছর চীনের অর্থনীতিতে ১.২ ট্রিলিয়ন  মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা  চীনের জিডিপির ১০ শতাংশ। বলা হচ্ছে যে, ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনের জিডিপিতে মেরিন সেক্টরের অবদান হবে ১৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান ছিল ৩৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ২ শতাংশ এবং ৩ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল। 
এবার আসি বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। সঙ্গে আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবই পেয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত এ রায় দুটিকে সবাই বাংলাদেশের ‘সমুদ্র বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। এ রায়ে বাংলাদেশের স্থলভাগের বাইরের জলসীমায় আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এখন এই বিজয়কে প্রকৃতার্থে অর্থনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হবে এর সম্পদ ব্যবহার করে, উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। 

এবার আসি দেশের কথায়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার বাংলাদেশকে যেমন দিতে পারে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা, তেমনি বদলে দিতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা হলেও আমরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছি। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে মাছ আহরণ বাড়বে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ পরিবার মৎস্য আহরণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদিত হয়, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পের অবদান প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিগত বছর লবণের চাহিদা ছিল প্রায় ১৭ দশমিক ৭৬ লাখ টন।

দেশে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ টন। লবণ চাষে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করে লবণ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এছাড়া সমুদ্র থেকে পেতে পারি ১৫ হাজার রাসায়নিক পদার্থ, যা দিয়ে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি সম্ভব। আগামী প্রজন্মের ওষুধ আসবে সমুদ্র থেকেই। 
বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণে বিশ্বে ১৩তম আর শিপ ব্রেকিংয়ে ৩য়। পৃথিবীর মোট জাহাজ ভাঙার ২৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশে সম্পাদিত হয়। দেশের দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলকে এ শিল্পের জন্য পরিবেশবান্ধব ভাবে কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য কক্সবাজার ও প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে এ অঞ্চলে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৩.৭   ভাগ। ডঙঞঞঈ-এর মতে, এ বছর শেষে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান দাঁড়াবে ৩৮ লাখ ৯১ হাজার, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৪.২ শতাংশ। তাই বাংলাদেশের সব উপকূলীয় জেলায় পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। 
সামুদ্রিক জীব থেকে কসমেটিক, পুষ্টি, খাদ্য ও ওষুধ পাওয়া যায়।

মেরিন শেলফিশ, ফিনফিস ফার্মিং করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল থেকে চড়ষুঁহংধঃঁৎধঃবফ  ঋধঃঃু অপরফ (চটঋঅং) যেমনÑ  ড়সবমধ-৩ ধহফ ড়সবমধ-৬ নামের ধহঃরড়ীরফধহঃং সমূহ বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের সমুদ্রের ২৮টি ব্লকের মধ্যে দুটি ব্লকে বহু জাগতিক কোম্পানি কনোকো- ফিলিপস প্রায় ৫ টিসিএফ গ্যাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ভারী খনিজের (হেভি মিনারেল) সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারী খনিজের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, গার্নেট, ম্যাগনেটাইট, মোনাজাইট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ।

এসব মূল্যবান সম্পদ সঠিক উপায়ে উত্তোলন করতে পারলে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হলে বাংলাদেশের বন্দরের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজসমূহের ফিডার পরিষেবা কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের বন্দরসমূহ কলম্ব, সিঙ্গাপুর বন্দরের মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশ সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা বা ঢেউকে ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো এই উৎসের ব্যবহার করতে পারেনি।

প্রতিবছর বায়ু থেকে আমরা পাচ্ছি ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি ভেস্টাস ইতোমধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছে, কক্সবাজার অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬-৮ মিটার, যা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী। ডেনমার্কের বিনিয়োগে কক্সবাজারে চালু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এ বায়ু উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০ মেগাওয়াট। 
বিশ্বের ৬৪ শতাংশ তেল বাণিজ্য এই জলপথের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম বন্দর হলো এই বিশাল অর্থনৈতিক এলাকার প্রবেশমুখ। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হলে চট্টগ্রাম হতে পারে এই বিশাল বাণিজ্যপথের প্রবেশমুখ। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি।

×