দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে যা ঘটল
স্বাধীন দেশে আর কতকাল আমরা এ জাতীয় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সাক্ষী হব? একটা জেলার কারাগার থেকে ৮২৬ কয়েদি নির্বিঘেœ চলে গেল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। এ ব্যর্থতাগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, জাতীয় গণমাধ্যম বিটিভিতে (যা কেপিআই নামে পরিচিত) ছয় ঘণ্টা ধরে তা-ব চালাল সন্ত্রাসীরা, তারপরও কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না। পরবর্তীতে এ বিষয়ে নিরাপত্তার ঘাটতি এবং বিটিভির কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল কিনা দেখা দরকার। আমাদের শেষ ভরসাস্থল হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা, দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ দুর্বৃত্তদের দমন এবং এদের কুশীলব ও অর্থদাতাদের মুখোশ উন্মোচন করে সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা
গত পক্ষকাল ধরে দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে যা ঘটল তা কারও কাম্য ছিল না। ২০১৮ সালে জারিকৃত কোটা সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্রকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দায়ের করা মামলায় কোর্ট পরিপত্রটিকে বাতিল করে পূর্ববর্তী কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সরকার আপিল বিভাগে যায়। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলতে থাকে। এর ব্যাপকতা বেড়ে ছড়িয়ে পড়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অপরদিকে, আপিল বিভাগ প্রাথমিকভাবে ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এনে সরকার শুনানি এগিয়ে আনার আবেদন করে। যার প্রেক্ষিতে আদালত গত ২১ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি শেষে মামলাটির রায় প্রদান করেন। রায়ে মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মেধা এবং কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় (মেধা কোটা ৯৩%, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য ৫%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১%, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১%)। আগের রক্ষিত জেলা ও মহিলা কোটা বাদ দেওয়া হয়। এতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করা হলো।
সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্ভবত একটু বেশি সময় গড়িয়ে গেছে। ফলে আন্দোলনটি ছিনতাই হয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করল। গত সপ্তাহ ধরে সারাদেশে ঘটে গেল তা-ব। দাবি আদায়ের আড়ালে অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসীরা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের এক অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। ধ্বংস করা হলো স্বপ্নের মেট্রোরেলের তিনটি স্টেশন, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাসহ অসংখ্য স্থাপনা।
গত ১৭ তারিখ থেকে শুরু হয় এই তা-বলীলা। ইতোমধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। বন্ধ হয়ে যায় সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। জাতীয় গণমাধ্যম বিটিভির সম্প্রচারসহ সারাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ। জনমনে ভীতির সঞ্চার হতে থাকে। অবশ্য সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে এ যাত্রায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। বড় ধরনের ঝামেলা শুরু হয় রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাঈদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আরও নমনীয় হওয়ার সুযোগ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এই মৃত্যুটিই পুরো দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য স্বার্থান্বেষী মহল কাজে লাগায়।
আসা যাক লাভ-ক্ষতির হিসাবে। কোটার বিষয়ে আদালতের রায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যে সমাদৃত হয়েছে। রাষ্ট্র এবং শিক্ষার্থী উভয়ের চাওয়া পূরণ হয়। বাদ সাধে সময়। এ কাজটা যদি আমরা আরও সাতদিন আগে করতে পারতাম, তাহলে হয়তবা শতাধিক প্রাণ বা হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ হারাতে হতো না।
পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার নিমিত্ত সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত এবং ২২ তারিখ রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কার্ফু বলবৎ করা হয়। সম্ভবত এর কোনো বিকল্পও ছিল না সরকারের হাতে। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করে। আশা করা হচ্ছে, দেশ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে দু’চারদিনের মধ্যে।
এরমধ্যে বারোটা বেজেছে শিক্ষার ক্ষেত্রে। চলমান উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, তা বলা মুশকিল। বিগত করোনাকালেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এটা অনস্বীকার্য। পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও চলছিল। এর মধ্যে আবার কারিকুলামে পরিবর্তন এনে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে নতুন পাঠ্যক্রম শুরু করা হয়েছে। পরিবর্তিত পদ্ধতিতে মাধ্যমিক স্তরের ষাণ¥াসিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন চলাকালীন ঘটে বিপত্তি। সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।
এ সকল ক্ষতির আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও তা যে অপূরণীয় এটি সর্বজনবিদিত। শিক্ষক হিসেবে মনে করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক মাস বন্ধ থাকলে পিছিয়ে পড়ে দুই মাসের জন্য। করোনাকালে আমাদের অল্প-বিস্তর অনলাইনে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা থাকলেও জাতীয় ডাটা সেন্টার সন্ত্রাসীদের নির্মম আক্রোশের শিকার হওয়ায় অনলাইন ক্লাস করার সুযোগও নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও রয়েছেন আন্দোলনে। বর্জন করে চলেছেন শ্রেণি কার্যক্রমসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ।
শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পেনশন পদ্ধতির ক্ষেত্রে নতুন পেনশন নিয়ম আরোপের বিষয়েও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণতার পরিচয় মেলেনি। বরং সংকট ঘনীভূত করে শিক্ষক-কর্মচারীদের রাস্তায় নামানো হয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিলেই যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে, তা বলা যাচ্ছে না।
গত ২০ তারিখ থেকে দেশের সকল অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যাংক-বিমাসহ সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে (জরুরি পরিষেবা এবং গণমাধ্যম ছাড়া)। ফলে মানুষের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। প্রি-পেইড মিটারে টাকা রিচার্জ করতে না পারায় অনেক পরিবার রয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের ফলে কিছুটা স্বস্তি ফেরানো গেছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছেÑ তিনি ছাড়া কি জনগণের প্রাপ্য নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করার আর কেউ নেই? কোথায় রইল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের লোকজন? প্রত্যেক বিষয়ে প্রধানন্ত্রীকে নজর দিতে হলে বাকিদের না রাখাই মঙ্গল।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, এটাই প্রত্যাশা।
আমাদের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হলো তৈরি পোশাক খাত। সরকারের নির্বাহী আদেশে সব গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রয়েছে। মালিক পক্ষের দাবি অনুযায়ী এতে প্রতিদিন এক হাজার ছয়শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ সকল ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সহজ নয়। দিনমজুর, রিক্সাপুলার, পরিবহন খাতের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকসহ যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের গত সপ্তাহ ধরে কোনো আয় নেই। এসব পরিবারে নেমে এসেছে বিপর্যয়।
তাদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় এটা ভাবা দরকার। এছাড়াও রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা এবং অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করেছেন মর্মে আশ্বস্ত করেছেন। অন্যদিকে সেনাপ্রধান বলেছেনÑ দু’একদিনের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করেছেন।
এসব কার্যক্রম স্বচ্ছ ও সততার সঙ্গে করা না গেলে বিপত্তি থেকেই যাবে। প্রকৃত সন্ত্রাসীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বা গোয়েন্দা বিভাগের কোনো ধরনের ব্যর্থতা থাকে, ভবিষ্যতের জন্য তাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ সন্ত্রাসীরা যা ঘটিয়েছে, সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্রকে এর জন্য বড় মূল্য দিতে হচ্ছে।
স্বাধীন দেশে আর কতকাল আমরা এ জাতীয় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সাক্ষী হব? একটা জেলার কারাগার থেকে ৮২৬ কয়েদি নির্বিঘেœ চলে গেল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। এ ব্যর্থতাগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, জাতীয় গণমাধ্যম বিটিভিতে (যা কেপিআই নামে পরিচিত) ছয় ঘণ্টা ধরে তা-ব চালাল সন্ত্রাসীরা, তারপরও কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না। পরবর্তীতে এ বিষয়ে নিরাপত্তার ঘাটতি এবং বিটিভির কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল কিনা দেখা দরকার।
আমাদের শেষ ভরসাস্থল হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা, দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ দুর্বৃত্তদের দমন এবং এদের কুশীলব ও অর্থদাতাদের মুখোশ উন্মোচন করে সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক (অব).