মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে নিজেদের রাজাকার বলার ধৃষ্টতা
বিশ্বাস ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে নিজেদের রাজাকার বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে না। প্রথম কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘রাজাকার’ বলেননি। দ্বিতীয় কথা হলো, নতুন প্রজন্ম বুঝতেই পারছে না ‘রাজাকার’ শব্দের অভিঘাত। দেখা যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি সরকারের ভাষা বুঝতে পারছে না, অন্যদিকে সরকারও বুঝতে পারছে না নতুন প্রজন্মের ভাষা। তাদের স্বপ্ন বুঝতে পারছে না।
মাঝখান থেকে শত্রুপক্ষ ঢুকে পড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের বিভাজন তৈরি করে দিল। পানি ঘোলা করে নিজেদের সুবিধামতো মৎস্য শিকারের ছক কাটতে শুরু করল সুযোগসন্ধানীরা। তারা ঘুঁটি বানাল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের
আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে সেই অরাজকতা, সহিংসতা, আগুন-সন্ত্রাস। ইতোমধ্যে কমপক্ষে ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। ছয়টি প্রাণ শুধু নয়, ছয়টি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে। যে কোনো মৃত্যুই নিন্দাযোগ্য। এসব মৃত্যু আমাদের বিমর্ষ, বিষণœ করে। আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন করে। রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও চিত্র যে কারও রক্তে দাবানল ছড়াবে।
আবু সাঈদ যখন দু-হাত তুলে বুক পেতে দিল, তখন আমাদেরই পুলিশ কী করে তার দিকে বুলেট ছুড়তে পারল? এ-তো পাকিস্তানি পুলিশ নয়, আমাদেরই পুলিশ। কেন গুলি ছুড়ল? কে নির্দেশ দিল? কারা চাইছে লাশ? কাদের দরকার লাশ? সেই লাশের সরবরাহকারী কারা? কার এজেন্ডা কে বাস্তবায়ন করছে?
এমন অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে। কারণ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে বোঝা যাচ্ছে, যারা আন্দোলন করছেন, তাদের আন্দোলনটা ছিনতাই করেছে অন্য একটি পক্ষ। তাদের লাশ চাই, তাদের আগুন-সন্ত্রাস ঘটানো চাই। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য যা যা করা দরকার, তার সবকিছু তাদের করা চাই। তারা একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম পেয়েছে। প্যারিসÑলন্ডন থেকে নির্দেশনা আসছে।
প্যারিসে বসে একজন তো প্রকাশ্যেই কোটা আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে বিএনপি-জামায়াত, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসের যাবতীয় দিকনির্দেশ দিচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ভেতরে মিশে কিংবা তাদের শিখ-ি বানিয়ে এই পক্ষটি যতটা সম্ভব পানি ঘোলা করতে চাইছে।
সুতরাং, এসব মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত এবং অপ্রয়োজনীয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাদের বিষাদাক্রান্ত করেছে, সেটি হলো- রাজাকার শব্দের ঘৃণ্য দিকটি উপলব্ধি করতে না পারা। ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার।’ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বলতে চাইছেÑ তারা চাইছিল অধিকার, কিন্তু হয়ে গেল রাজাকার। অর্থাৎ, তাদের রাজাকার বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
এখানেই রয়েছে বিরাট এক প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী কি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলেছেন? বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি কোটা পাবে না, তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে? সেটা আমার প্রশ্ন। দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন।’ অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কখনই ‘রাজাকার’ বলেননি। কিন্তু তারপরও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বৃহত্তর অংশের আবেগ নিয়ে খেলল। তাদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের একটি অংশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফাঁদে ফেলল।
বোঝাল-দেখো, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিস্ময়াহত হলো, আবেগে ভাসল-প্রধানমন্ত্রী তাদের রাজাকার বলেছেন! যদি তা-ই বলে থাকেন, তবে তারা তাই-ই। অর্থাৎ, তারা রাজাকার! সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেনÑ ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’ সুতরাং কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের আঁতে লাগে। কান নিয়েছে চিলে শুনে তারা চিলের পেছনে ছুটল, অথচ নিজের কানটি একবার হাত দিয়ে দেখল না।
তারা বুঝল না- রাজাকার শব্দের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারে কেবল পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। কোনো খেদোক্তি কিংবা কোনো অভিমান থেকেও ‘রাজাকার’ শব্দের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করা যায় না। সেই কারণে নতুন প্রজন্মের এই ‘রাজাকার’ উচ্চারণ দেখে আমার মহামতি যিশুর বাণী মনে পড়ে যায়। যিশুর প্রতি নৃশংসতায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সেই মহান বাক্য- ‘পিতা, এদের ক্ষমা করো; কারণ, এরা জানে না এরা কী করছে।’
নিশ্চয়ই নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। তারপরও নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ রইলÑ রাজাকার, আলবদর, আল-শামসরা একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালির ওপর কত ধরনের ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে, সেসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করে দেখতে। অন্তত তারা যেন বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি : ১৯৭১’-এর চার খ-ের একটি অংশ পড়ে দেখে। তারা এসবের সামান্য অংশ পড়লেও শিউরে উঠবে। তাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ হবে। রাজাকারদের নৃশংসতার বর্ণনা পড়ে তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।
এমনকি রাজাকারের পুত্ররাও যদি তাদের পূর্বসূরিদের নৃশংসতার এসব কাহিনী পড়ে, তারা তাদের পিতাকে ঘৃণা না করে পারবে না। সেই কারণে নতুন প্রজন্মের এই ‘রাজাকার’ উচ্চারণ দেখে মহামতি যিশুর মতো আমারও বলতে ইচ্ছ করেÑ ‘পিতা, এদের ক্ষমা করো; কারণ, এরা জানে না এরা কী করছে।’
আমি আরেকটু ঘুরিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই- প্রধানমন্ত্রী যদি বলতেন- ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি কোটা পাবে না, তাহলে কী ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ নাতি-পুতিরা কোটা পাবে?’ তাহলে কি এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ‘কে তুমি কে আমি- যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধী’ স্লোগান তুলত?
বিশ^াস ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে নিজেদের রাজাকার বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে না। প্রথম কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘রাজাকার’ বলেননি। দ্বিতীয় কথা হলো, নতুন প্রজন্ম বুঝতেই পারছে না ‘রাজাকার’ শব্দের অভিঘাত। দেখা যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি সরকারের ভাষা বুঝতে পারছে না, অন্যদিকে সরকারও বুঝতে পারছে না নতুন প্রজন্মের ভাষা। তাদের স্বপ্ন বুঝতে পারছে না।
মাঝখান থেকে শত্রুপক্ষ ঢুকে পড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের বিভাজন তৈরি করে দিল। পানি ঘোলা করে নিজেদের সুবিধামতো মৎস্য শিকারের ছক কাটতে শুরু করল সুযোগসন্ধানীরা। তারা ঘুঁটি বানাল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। বলা যায়, সরকার এই সুযোগ তাদের হাতে সুন্দরভাবে তুলে দিল। এখন স্বাধীনতাবিরোধী দোসররা এই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য যা যা করার তা-ই করছে। তারা উঠেপড়ে লেগেছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় আট মিনিটের ভাষণের সার্বিক দিকটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ছয়টি তাজা প্রাণ, ছয়টি অপূর্ব স্বপ্নের এমন মৃত্যুতে তিনি যে শোকাহত, সেটা তার কালো শাড়ি পরিধানের মধ্যে স্পষ্ট। তিনি পুত্রহারাদের শোক ও বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বুঝিয়েছেন যে, স্বজনহারানোর বেদনা তার চাইতে আর কে ভালো জানেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন যে, শিক্ষার্থীরা আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাবে, হতাশ হতে হবে না।
কোটার বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করেছেন তিনি। সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। আপিল আদালতে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। কোটা নিয়ে আন্দোলনকে ঘিরে হত্যাকা-সহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেসব বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার কথাও বলেছেন তিনি।
সুতরাং সরকার তো কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে নয়। তাহলে জটিলতা কোথায়? আমরা দেখেছি, গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুড়ে ফেলেছে। তাদের ওপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করেছে। ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার চায়। সরকারও চায়। ২০১৮ সালে ছাত্রসমাজের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল এই সরকারই। কিন্তু সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোটা বহাল রাখার পক্ষে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের জারি করা পরিপত্র বাতিল করে দেয়। তাহলে পরিপত্রটি কে বাতিল করল? সরকার তো বাতিল করেনি, করেছে উচ্চ আদালত।
সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষেই সেই পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছে এবং আদালত শুনানির দিন ধার্য করেছে। গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষাও সম্পূর্ণ কোটাবিহীনভাবে হয়েছে। সরকার কোটা বাতিল করার পর একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্টে গিয়েছিল। তখন হাইকোর্ট সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দেন। অর্থাৎ, বিষয়টি আদালতের। তবে হাইকোর্টের এই রায়টি আবার সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে দিয়েছেন।
অর্থাৎ, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের স্থিতাদেশ অনুযায়ী কোটা নেই। এখন আমরা সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর মতো আমরাও বিশ^াস করি, যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত, তাদের সঙ্গে এসব সন্ত্রাসীর কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে সন্ত্রাসটা হচ্ছে কোথা থেকে?
এখন, এসব সত্য জানার পরও যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, লাশ চাচ্ছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছেনÑ তাদের ফাঁদে কেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা পা দিচ্ছেন? তাদের আন্দোলনকে কেন হাইজ্যাক হতে দিচ্ছেন?
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, এই জীবনসায়াহ্নে এসে ভেবেছিলাম অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সুন্দর একটি দেশ দেখে এই জনম শেষ করতে পারব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার জনম গেল বৃথা কাজে। সেই স্বপ্ন সম্ভবত ভঙ্গ হতে চলেছে। এ স্বপ্নভঙ্গ যে কতটা বেদনাদায়ক, কত মর্মান্তিক! এই অপরাহ্ণবেলায় এসে এভাবে ভাবতে হবে, এমন সব ঘটনা দেখতে হবে- তা ছিল কল্পনাতীত।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করে আমরা যে দেশ অর্জন করেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসারথি হয়েছি সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে, সেখানে দেশটিকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা কখনই এভাবে দেখব বলে ভাবিনি। এ বেদনার সীমা-পরিসীমা নেই, এই দুঃখের শেষ নেই। ভেবেছিলাম শান্তিতে এই পৃথিবী ত্যাগ করতে পারব, কিন্তু প্রচ- বেদনাহত হয়েই হয়তো এ ধরাধাম ছাড়তে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ