ড. শামীম আহমদে
দেশে বিসিএস পরীক্ষার কোটা পদ্ধতি নিয়ে বড় ধরনের একটি আন্দোলন হচ্ছে। ২০১৮ সালের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেলেও সম্প্রতি আদালতের রায়ে আবার কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করা হবে বলা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে, রাস্তায় নেমেছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কোটা পুনর্বহালের বিপক্ষে। যারা এর পক্ষে তারাও ৫৬ শতাংশ কোটা অর্থাৎ ১০০ জনে ৫৬ জন কোটার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে আর বাকি ৪৪ শতাংশ সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, এটিকে অযৌক্তিক মনে করছে। আমার নানাজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে সীমিত কোটায় কারও কোনো আপত্তি নেই।
অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা থাকলে সেটি মেনে নিতে আগ্রহী যে কেউ। এই কোটার ভিতরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী কোটা নিয়ে প্রায় সবাই একমত। জেলা কোটা অধিকাংশের কাছেই অযৌক্তিক। বেশিরভাগ বিচক্ষণ মানুষ নারী কোটার যৌক্তিকতাও বোঝেন। তবে সার্বিকভাবে প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য কোটা মেনে নিতে পারছেন না। যারা কোটার পক্ষের তারা এদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করছেন যা দু’পক্ষকে মুখোমুখি করে দিয়েছে।
আদতে আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা যদি সরকারি চাকরি করার বয়সের মধ্যে থাকে, তাহলে তাদের কোটা দিতে কারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এখন দেশে এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা বা তার সন্তান নেই যে, সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সী। অর্থাৎ এই কোটার সুবিধা নিতে পারবে কেবলমাত্র মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি যা অধিকাংশের মতোই অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য।
এই আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্ম হলেই তারা কি সবাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি? আমরা কি গত কয়েক দশকে শত শত, এমনকি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সন্তানদের দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধের বিপক্ষে দাঁড়াতে দেখিনি? সেক্ষেত্রে তাদের নাতি-নাতনিদের এসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া কতটা যৌক্তিক? কতজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি নিজেরাই বা এই সুযোগ নিতে চাইবেন?
আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি অনেক দেশবরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা নিজেরাই ঘোষণা দিচ্ছেন যে, তারা এই কোটা চান না। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বীর, তাদের অবদানের জন্য আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতিম খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। সরকার চাইলে আরও বেশি বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে এই উপাধিতে ভূষিত করতে পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মূল ভূমিকা রেখেছেন গ্রামের সাধারণ চাষি, শ্রমিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সর্বোচ্চ খেতাব কেবল সেনাসদস্যদের দেওয়া হয়েছে যা আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং আমাদের সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, জেলে যারা সর্বোচ্চ সাহস ও বীরত্ব দিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে, তাদেরকেও বীরউত্তম উপাধি দেওয়া হোক।
জিয়া-এরশাদ-বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সেনাসদস্য নয়, এমন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারদের বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রাথমিকভাবে এবং ২০০৮ সালে পুনরায় দায়িত্ব নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এসব বৈষম্য দূর করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা, ভাতা বহুগুণে বাড়িয়েছেন।
সরকার চাইলে তাদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে পারেন, দেশের মানুষ তাতে পূর্ণ সমর্থন দেবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটা যা কেবল তাদের নাতি-নাতনিরা পাবে, এই ব্যবস্থা চালু করে দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনতার মধ্যে যে বিরোধ চালু করেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক এবং দূরদৃষ্টির অভাব বলে মনে করি। আমরা জানি এই রায় আদালতের, কিন্তু আমরা এটাও জানি সরকার চাইলে এবং তারা যদি আদালতকে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেয়, তবে আদালত দেশের সাধারণ মানুষের যৌক্তিক দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের রায় সংশোধন করতে পারেন।
কোটা সংস্কার যখন এই মুহূর্তে দেশে একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়, তখন আমার মনে হয়, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা করা উচিত। কেবল কোটা সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মধ্যে চলমান এই অস্থিরতা, দুর্নীতি, অসততা, শঠতা ইত্যাদি নির্মূল করা যাবে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে আমরা আমাদের সন্তানদের পড়াতে চাই, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন সে বিষয়ে কি আমাদের পরিষ্কার ধারণা আছে?
আমেরিকা, কানাডায় কি একটি সর্বজনীন পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়? এটি কি আদৌ সম্ভব যে সরকারের রাজস্ব বিভাগে যে কর্মকর্তা কাজ করবেন তার এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যিনি কাজ করবেন, উভয়ের যোগ্যতা একই হবে? এটি তো সম্ভব নয়। আমাদের বিসিএস পরীক্ষার এই অংশটি নিয়ে আমরা কেন ভাবছি না? আমাদের কেবল সরকারি নিয়োগই নয়, স্কুল পর্যায় থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কানাডার শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো এসএসসি নেই, এইচএসসি নেই, ও লেভেল নেই, এ লেভেল নেই। সবাই ক্লাস ১-১২ পর্যন্ত পড়ে। নিজের স্কুলেই পরীক্ষা দেয়। তারপর পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দেয়। হাই স্কুল অর্থাৎ গ্রেড ১১-১২ এর গ্রেড, সহশিক্ষা কার্যক্রমের মান, লেখার ধার, পড়ার বিষয়ের আগ্রহ, সব বিবেচনায় ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়। তারপর ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে সরকারের যে বিভাগে যেতে চায় সেখানে আবেদন করে। অন্তত ৩-৪ ধাপের যাচাই-বাছাই পার হতে পারলে সেখানে প্রথমে অস্থায়ী চাকরি পায়।
তারপর কাজের মান, সরকারের বাজেট ইত্যাদির ভিত্তিতে সে চাকরি স্থায়ী হয়। আবার স্থায়ী চাকরি চোখের পলকে চলেও যেতে পারে। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো জাতীয় বিষয় নেই। সারাদেশের ছেলেমেয়েদের একই সঙ্গে আলাদা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয় না। যে যার স্কুলে পরীক্ষা দেয়। কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবে না যে নিজের স্কুল পরীক্ষার কেন্দ্র হলে সেখানে অনৈতিক কিছু হবে। পড়ালেখা শেষে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে উপসর্গ, কারক, কোন্ দেশের রাজধানীর নাম কী, কোন্ নেতার জন্মদিন কবে, এইসব বিষয়ে ২ লাখ শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে হয় না। যেই বিভাগে যেমন যোগ্যতা দরকার, তার ভিত্তিতে আবেদন করতে হয়।
এই যে স্কুলে-কলেজ-ইউনিভার্সিটি-সরকারি চাকরি সবক্ষেত্রে একটা সেন্ট্রাল পরীক্ষা ব্যবস্থা- এটা অত্যন্ত প্রাচীন এবং ভুলে ভরা একটা সিস্টেম। বিশেষত এমন একটা জাতির জন্য যেখানে সততা সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু। এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে বলেই এখনো নটর ডেমে, বুয়েটে ভালো শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। সেন্ট্রাল ভর্তি এবং সেন্ট্রাল পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়া ছাড়া লাখ লাখ মানুষকে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
১৪ জুলাই ২০২৪
[email protected]