ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
আয়োজনটা সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আর মঞ্চটা বিশ^বিদ্যালয়ের তৃতীয় লিভার উৎসবের। বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই ‘উৎসবের’ নামটা নিয়ে খোদ এই বিশ^বিদ্যালয়ের অনেকেরই ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণটাও অবশ্যই বোধগম্য। আমাদের কাছে উৎসব মানেই তো গান-বাজনা, আমোদ আর হৈ হুল্লোর।
অথচ সেই জায়গায় এই উৎসবটি বিজ্ঞান উদযাপনের। কয়েকদিন আগে একজন তো মুখের ওপরই বলে বসলেন, ‘যা কিছু একটা নাম দিয়ে দিলেই হলো আর কি।’ বক্তার বক্তব্যে উৎসবটির উদ্বোধনী মঞ্চের সামনে বসা তিন শতাধিক বিশেষজ্ঞের করতালিতে অডিটরিয়ামটি সরগরম। কারণ, মঞ্চে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিশেষ অতিথি এই বিষয়টিই তার বক্তব্যে তুলে এনেছেন। বলছিলেন, উৎসবটিতে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে তারও প্রথম ধারণা জন্মেছিল যে, দেশের এই শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হাইটেক ডিভিশনটির তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে কেক কাটা, গান-বাজনা ইত্যাদির আয়োজন থাকবে। থাকবে হয়তোবা নাচ-গানও, এমনকি কে জানে নাটক-কবিতাও।
কিন্তু তাই বলে উৎসবে আলোচনা হবে বিজ্ঞান আর উদযাপনটি হবে বিজ্ঞানচর্চার, এমন ধারণা তার ছিল না। তাই শুরুতে অনুষ্ঠানস্থলে এসে একটু ধাক্কামতন খেলেও, উৎসবের বিষয়টি তার কাছে সহসাই স্পষ্ট হয়েছে। এখানে উদযাপন জীবনঘনিষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চার, যার চর্চা দেশের এই শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম ডিভিশনটিতে চলমান। এই কারণেই বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে তিনি অনেক বেশি বিস্মিত উৎসবের উদযাপনের ভিন্নতায় এবং পাশাপাশি তার চেয়েও ঢের বেশি পঞ্চমুখ প্রশংসায়। বিজ্ঞানের উদযাপনটা হতে হবে এমনটাই।
চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চাকে শুধুই গবেষণাগার আর বেডসাইডের কাঠখোট্টা বিষয় বানিয়ে রেখে দিলে চলবে না। এটি হতে হবে উপভোগের, সাফল্যগুলো সম্মিলিত উদযাপনের আর পাশাপাশি প্রত্যাশিত ফল অর্জনে ব্যর্থতাগুলো একসঙ্গে ভাগ বাটোয়ারারও। শুরুতেই তো পৃথিবী মাতবে না আমাদের সৃজনশীলতায়। কাজেই আমাদের পীঠগুলো চাপড়াতে হবে আমাদেরই।
বিজ্ঞান হবে উৎসবমুখর আর যে মাটি একদিন জন্ম দিয়েছিল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বোস আর সত্যেন বোসের মতো অমর, সৃজনশীল বিজ্ঞানীদের, তাদের উত্তরসূরিদের চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চায় যে একদিন ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রইবে’, এ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে আমার যে ঈষৎ সংশ্লিষ্টতা, সেখানটায় দাঁড়িয়ে অন্তত নিঃসংকোচে বলতে পারি যে, আমার তা নিয়ে সন্দেহের এতটুকুও অবকাশ নেই।
নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে বক্তার বক্তৃতায় দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানচর্চার ব্যবচ্ছেদটাও দারুণ। এদেশে বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় কার্যকারণ পদ-পদবির উত্তরণ। সহকারী অধ্যাপক ঠিক ততটুকু গবেষণা করেন যতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করলে তার পরবর্তী পদ অর্থাৎ সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন। ঠিক একই কাজ করেন সহযোগী অধ্যাপকরাও, আর তেমনটাই প্রযোজ্য অধ্যাপকদের বেলায়ও।
যাদের গবেষণা শুধুই পরবর্তী গ্রেডটিকে টার্গেট করে পরিচালিত। আমাদের বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রিক গবেষণার দুটো বড় বাধার অন্যতম এটি। অপর বাধাটিও কম কিছু নয়, বরং তা আরও বিশাল। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম মূলত আন্ডারগ্র্যাজুয়েটরে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতার সঙ্গে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের ঠিকই গ্র্যাজুয়েটে রূপান্তরিত করা হয়। অথচ এর ঠিক বিপরীত চিত্রটা ওইসব গ্র্যাজুয়েটের বেলায়, যারা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট থেকে এই বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেই তাদের শিক্ষাগত অবস্থার উত্তরণ ঘটাচ্ছেন। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গ্র্যাজুয়েটদের অধিকতর জ্ঞানদান আর তাদের জন্য গবেষণায় মেতে থাকার ক্ষেত্রগুলো খুবই সীমিত।
আর যাওবা কিছু কিছু গবেষণা হালে পানি পাচ্ছে, সেসবও খুব কম ক্ষেত্রেই জীবনঘনিষ্ঠ। ব্যতিক্রমটা কিছুটা কৃষিতে। যেখানে গবেষণাটা অনেকটাই জীবননির্ভর ও জীবিকাকেন্দ্রিক। অন্যান্য সেক্টরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে হাতেগোনা কিছু উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চা, যা আমাদের বিশ^বিদ্যালয় এবং উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান, তার অধিকাংশ প্রকাশনাকেন্দ্রিক। ভালোমানের জার্নালে একটি প্রকাশনা নানা সীমাবদ্ধতার বাধা পেরিয়ে যখন একজন গবেষকের হাতে আসে, তখন বিষয়টি তার কাছে হাতের মুঠোয় চন্দ্রপ্রাপ্তির সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।
তবে ল্যানসেট কিংবা নেচারের ওই প্রকাশনায় আমার গ্রামের আবুল, কিংবা পাশের বস্তির কাবুলের লাভ-ক্ষতি কতখানি, সেই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি ভারি-ভারি জার্নালের ভার-ভারিক্কিতে ধামাচাপা পড়ে যায়। অথচ হওয়াতো উচিত ছিল এর উল্টোটা। আমাদের গবেষণা তো হতে হবে আমাদেরই আবুল আর কাবুলকেন্দ্রিক। আর তা যদি নেচারে যায়, কিংবা যায় ল্যানসেটে তবে তা তো হবে, যাকে বলে এক কথায় সোনায় সোহাগা। তবে নেচার কিংবা ল্যানসেটে না ছেপেও আমাদের গবেষণাগুলো যদি আমাদের জনগণের এক আনাও উপকারে আসে, সেটাই তো গবেষণার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের তৃতীয় বর্ষপূর্তির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তা যখন তার বিশেষ অতিথির নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের বিজ্ঞান উৎসবের এহেন ব্যাখ্যা প্রদান করছেন আর সেই সঙ্গে দারুণ ব্যবচ্ছেদে তুলে আনছেন কি হওয়া উচিত দেশের বিজ্ঞান গবেষণার হাইপোথিমস ও মেথোডোলজি, অডিটরিয়ামে উপস্থিতির বাধভাঙ্গা হাততালিতে অডিটরিয়ামটি তো তখন উন্মাতাল হবেই। কারণ, সেই বক্তাটি যে স্বয়ং অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল।
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ