বিএনপি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল
বিএনপি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল। দলটি বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করেছে। সঙ্গত কারণেই দেশব্যাপী দলটির কর্মী-সমর্থকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দলটি রাজনৈতিক মাঠে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বিএনপির মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের রাজনীতি চলছে। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব ও অবিশ্বাস, সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিরোধ ও আস্থাহীনতা, দলীয় সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে না পারা ইত্যাদি কারণে বিএনপির মধ্যে বিরাজ করছে অসন্তোষ।
একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের কল্যাণ সাধন করা। সে কারণেই বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সেবা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে দলীয় কোন্দল ও সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি বিদেশনির্ভরতার কারণে দলটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত বিএনপির অসংখ্য কর্মী-সমর্থক তথা তৃণমূলের কর্মীদের মনে হতাশা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের অবিবেচক সিদ্ধান্তের কারণে দলটির প্রতি আস্থা হারিয়েছে দলের সমর্থকরাও।
সময় সময় সরকার পতনের নিমিত্তে প্রদত্ত বিএনপির কোনো কর্মসূচিই ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। বিশেষত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। তবে নিয়মিত বিরতিতে কর্মসূচি আহ্বান করেছে বিএনপি। বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তৃণমূল নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তাকে দুষছেন। দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও দায়ী। তাছাড়াও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ঘিরে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা ও দীর্ঘদিনের কারাবাস এবং দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রবাসে অবস্থানের কারণে বিএনপির নেতৃত্বে কার্যত একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ শূন্যতা পূরণের জন্য দলীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অধিকন্তু আন্দোলনের আহ্বান করে শীর্ষ নেতাদের মাঠে না থাকাও দলের অন্যতম ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের অসুস্থতা এবং নিষ্ক্রিয়তার কারণে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন। এ নিয়ে দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বিধা দেখা গিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে মতবিরোধ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘দলের পদ পরিবর্তন, পদায়ন তো চলমান প্রক্রিয়া, এটা যে কোনো রাজনৈতিক দলেই সারা বছর চলতে থাকে।’
অন্যদিকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবই দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। বিএনপির চলমান এই সংকটের অন্যতম একটি কারণ হলো, সময়মতো দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়া। চেয়ারপারসন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের নির্বাহী ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের ফলে তৃণমূল পর্যায়ের অংশগ্রহণ যেমন নিশ্চিত হচ্ছে না, তেমনি বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ এবং অন্তর্কোন্দল। দলীয় কাউন্সিল একটি রাজনৈতিক দলের জন্য জাতীয় নির্বাচনস্বরূপ। এর মাধ্যমে যেমন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, তেমনি ত্যাগী ও যোগ্যদের মূল্যায়নের সুযোগ থাকে।
বিএনপির আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো তরুণ নেতৃত্বের অভাব। দলের সিনিয়র নেতারা দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বে থাকায় নতুন ও উদ্যমী নেতাদের জন্য সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এতে করে দলের অভ্যন্তরে একটি জড়তা দেখা দিয়েছে। যা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার জন্য অপ্রতুল। এছাড়াও নেতৃবৃন্দের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং নেতৃত্বের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাসের ফলে দলের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং এতে করে দলে নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি বন্ধ হয়ে যায়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রাণভোমরা হচ্ছে তরুণ উদীয়মান নেতৃত্ব এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় নিয়মিত কাউন্সিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
এদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গণআন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে আসছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে তারা জনগণকে একীভূত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে দলীয় সাংগঠনিক দৃঢ়তা ব্যতিরেকে জনগণের ম্যান্ডেট আদায় করা যায় না। সঙ্গত কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ঘোষিত আন্দোলনগুলো তেমন কার্যকর হতে পারেনি।
দলের ভেতরে নেতৃত্বের সংকট এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে আহূত আন্দোলনগুলোতে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং নেতৃত্বের অভাব দেখা দিয়েছে সবসময়ই। নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাসের কারণে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তবে সময়ই বলে দেবে বিএনপি এই সংকট অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না? তবে এই মুহূর্তে নেতৃত্ব বদল ও পরিবর্তন নিয়ে বিএনপির মধ্যে যে সন্দেহ-অবিশ্বাসের খেলা শুরু হয়েছে তা দলটির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক অশনি সংকেত।
বিএনপির মধ্যে চলমান সংকটকে প্রতিহত করার উদ্যোগ বিএনপিকেই গ্রহণ করতে হবে। দেশের বাইরে থেকে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দলের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে কাউন্সিল আয়োজন করে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। জেলা পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত হয় ঢাকা থেকে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যেখানে সম্মেলনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেখানে লোক দেখানো সম্মেলন আয়োজিত হলেও ঘোষণা করা হয় পকেট কমিটি।
তাছাড়া বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে আস্থাহীনতা বরাবরের মতোই বিদ্যমান। দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, দলের দুর্দিনে কা-ারির ভূমিকায় উত্তীর্ণরা দলের নেতৃত্বে আসতে পারছে না। সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না। দেখা যায় দলের সিনিয়র নেতৃত্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, পরবর্তীতে লন্ডনের ফোনে সিদ্ধান্ত বদলে বাধ্য হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে বিএনপির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। আবার যারা রয়েছেন তারা পর্যায়ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।
উল্লিখিত সব কারণে বিএনপি বারবার চেষ্টা করেও ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া একটি রাজনৈতিক দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে তখন দলটির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কারণে শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা মনে করেন দল পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদানকারীরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। বিএনপিতে এ ধরনের সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। তাছাড়াও তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বিএনপির নিকট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির জোটকে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মেনে নিতে পারেননি।
এ জায়গাতে বিএনপি দলীয়ভাবে এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। শীর্ষ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে মুখ খুলতেও নারাজ। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির জন্য এসব মূলত ব্যর্থতার পরিচায়ক। কাজেই বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে সংস্কারের মাধ্যমে। তরুণ উদীয়মান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে, যারা আগামীতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সংস্কৃতি থেকে বিএনপিকে বের হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তৃণমূলের সঙ্গে বৈঠকে বসে দলকে সাংগঠনিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তরুণদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে উপনীত হতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, সবকিছুতেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করে রাজনীতিতে দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে দল পরিচালনার শপথ গ্রহণ করতে হবে বিএনপিকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়