প্রসঙ্গ ইসলাম
আহলে বাইত রাসূলের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দরদ। আহলে বাইত রাসূল অর্থ আমাদের নবী পরিবারের সদস্য-সদস্যাবৃন্দ। আজ ৬ মহরম। ইতিহাসে মহরম মাস সর্বাধিক ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী। নানা কারণে এটি পবিত্র ও ইবাদতের মাস। এ মাসের ১০ তারিখ কারবালার ময়দানে ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র পরিবারের বেশ ক’জন সদস্য। এরপর থেকে পবিত্র আহলে বাইত প্রতিটি মুসলমানদের হৃদয় মাঝারে বিশেষ কোমল স্থান দখল করে আছে।
শাব্দিক অর্থে আহলে বাইত হচ্ছে গৃহবাসী এবং পারিভাষিক অর্থে পরিবার। সুতরাং আহলে বাইত অর্থ নবীর পরিবার। আমরা বার্ধক্যে উপনীত হলে নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জন্য বড় পেরেশান হয়ে যাই এবং বলে থাকি আমার পরিবারের প্রতি তোমরা খেয়াল রেখো। পরিবারের সদস্যদের প্রতি সদাচরণকে নিজের প্রতি সদাচরণ এবং পরিবারের প্রতি দুঃখ কষ্টদানকে নিজের প্রতি কষ্টদানই বুঝে থাকি।
রাসূল (স.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে তার পরিবারের জন্য আল্লাহকে স্মরণ করার কথা বলেছেন। রাসূল (স.) এর পরিবারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইমানেরই দাবি। তাঁর পরিবারের অশ্রদ্ধা-ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে কেউ নবী প্রেমিক হতে পারে না। আর নবীর অনুসরণ বা নবীর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আল্লাহ প্রেমিক হওয়াও সম্ভব নয়। নামাজের মধ্যে দরুদ পাঠের ব্যবস্থা আহলে বাইতের মধ্যে ভক্তি শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। ইমানদার সকল নর-নারীই আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে থাকেন।
আহলে বাইত কারা এবং তাদের মর্যাদা কী? এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীম স্পষ্টা বক্তব্য দিয়েছে। সূরা আহযাবে বলা হয়েছে- ‘হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে থাক তাহলে মিহিস্বরে কথা বলো না, যাতে গলদে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে। বরং পরিষ্কার-সোজা ও স্বাভাবিকভাবে কথা বল। নিজেদের গৃহমধ্যে অবস্থান কর এবং পূর্বের জাহেলি যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেরিও না। নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও, আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কায়েম কর। আল্লাহতো চান তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে।
কুরআনে স্পষ্টভাবেই নবীর স্ত্রীগণকে তার পরিবার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে রাসূল (স.) এর কন্যাকে তার নিজের অংশ ও দৌহিত্রকে তার পুত্র পরিচয় এবং আলী (রা.) কে পরিবারের অংশ করে নেওয়া হয়েছে। হযরত ইয়াজিদ ইবনে হাইয়্যান (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হোসাইন ইবনে সাবরা এবং আমর ইবনে মুসলিমসহ যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) এর কাছে গমন করলাম। আর যখন তার কাছে গেলাম, হোসাইন (রা.) তাকে বলেন, হে যায়েদ! আপনি অনেক কল্যাণ অর্জন করেছেন।
আপনি রাসূল (স.) কে দেখেছেন আপনি তার হাদিস শুনেছেন, আপনি লড়াইয়ে তার সাথী হয়েছেন এবং তার পেছনে সালাত আদায় করেছেন। হে যায়েদ! আপনি রাসূল (স) হতে যা শুনেছেন তা আমাদের বলুন। তিনি বললেন, হে ভাতিজা! আল্লাহর শপথ! আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আমার জামানা পুরনো হয়ে গেছে এবং আমি রাসূল (স.) হতে যা হিফজ করেছিলাম তার কোনো কোনো অংশ ভুলে গেছি। সুতরাং আমি তোমাদের যা বলব তা গ্রহণ করবে আর যা বলব না তার জন্য আমাকে কষ্ট দেবে না।
এরপর তিনি বলেন, মক্কা মদিনার মধ্য পথে গাদিরে খুম নামক স্থানে আল্লাহর হামদ ও নাত এবং ওয়াজ নসিহতের মুহূর্তে রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, হে মানবম-লী। ভালো করে শোন। আমি কিন্তু মানুষ! সুতরাং যখন ফেরেশতা জান কবজ করার জন্য আসবে তার সঙ্গে আমাকে অবশ্যই সাড়া দিতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব কুরআন। এর মধ্যে হিদায়াত এবং নূর বিদ্যমান রয়েছে। তাই তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরবে এবং সেই মোতাবেক আমল করবে।
রাসূল (স.) আল্লাহর কিতাবের প্রতি অনুপ্রাণিত এবং আকৃষ্ট করার জন্য ১ নাম্বারে কুরআনের কথা উল্লেখ করার পর ২য় নম্বরে বলেন, আমি তোমাদের আমার পরিবার পরিজন সম্পর্কে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে নির্দেশ দিচ্ছি। রাসূল (স.) তাঁর এ বক্তব্য তিনবার উচ্চারণ করেন। হযরত হুসাইন (রা.) বর্ণনাকারীকে প্রশ্ন করলেন, হে জায়েদ! আহলে বাইত কারা? রাসূল (স.) স্ত্রীগণ কী আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত নন? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। রাসূলের স্ত্রীগণও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত।
তবে মূলত আহলে বাইতের সদস্য তারা যাদের প্রতি সদকা গ্রহণ করা হারাম। হযরত হুসাইন (রা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, তারা কারা? হযরত জায়েদ বললেন হযরত আলী, আকিল, জাফর এবং হযরত আব্বাস (রা) এর পরিবার পরিজন। তাদের সবার জন্যই কী সদকা হারাম করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
বুখারির রেওয়ায়েতে এভাবে আহলে বাইতের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করতে বলা হয়েছে : হে আল্লাহ! আপনি হযরত মুহাম্মদ (স.), তার স্ত্রীগণ এবং তার সন্তান সন্ততিদের প্রতি অফুরন্ত রহমত নাজিল করুন। (সহিহ মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন, হাদিস নং ৩৪৭)।
আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে অন্যদের প্রতি কখোনই কোনো বিদ্বেষ বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ যেন না হয়ে যায়। কারণ স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কুরআনের বাণী- মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম ইমান এনেছেন এবং পরে যারা একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ তায়ালার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য এমন এক সুরম্য জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে; আর তাই হবে সর্বোত্তম সাফল্য (সূরা আত তাওবা)।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব