ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

দুর্যোগে সহযোগিতা ও মানবিক দায়বদ্ধতা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫০, ৮ জুলাই ২০২৪

দুর্যোগে সহযোগিতা ও মানবিক দায়বদ্ধতা

সমুদ্র, নদ-নদী আর পাহাড়ঘেরা সুশোভিত বাংলাদেশ

সমুদ্র, নদ-নদী আর পাহাড়ঘেরা সুশোভিত বাংলাদেশ। প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন চিরায়ত বাংলা শুধু নিসর্গের দানে ভরপুর নয়, হরেক মাত্রার প্রাকৃতিক বিপন্নতারও শিকার। ষড়ঋতুর অবগাহনে আবহমান বাংলার যে সৌন্দর্য মহিমা তাও এই অঞ্চলের অবারিত বৈভব। বর্তমানে আমরা পার করছি ঋতু বৈচিত্র্যের ঘন ঘোর বরিষাকে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টিস্নাত আবহ যেমন মানুষকে শান্ত-স্নিগ্ধতার আবেশ দেয়, সেখানে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও নাজেহাল করতে যেন এগিয়েই থাকে।

উপকূলবর্তী অঞ্চলসহ সারাদেশ এখন অবারিত বৃষ্টির ধারায় ডুবন্ত অবস্থায়। সিলেট, সুনামগঞ্জ থেকে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ফেনী এমন সব অঞ্চলও বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারায় প্লাবন বয়ে যাওয়ার চরম দুরবস্থায়। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি গত দুই শতকে যে মাত্রায় পরিবর্তিত অবস্থাকে সামাল দিয়ে এগিয়ে চলছে, সেটাও শাশ্বত বাংলার ভিন্ন মাত্রার প্রাকৃতিক বৈরিতা। ষড়ঋতুর বিচিত্রি আবহ আর আগের মতো কোলের সন্তানদের মাতিয়ে দেয় না। আবার খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ধসের যে নানামাত্রিক দুঃসহ প্রতিবেশ, সেটাও জনগোষ্ঠীর জন্য এক অবাঞ্ছিত দুর্গতি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে ভয়াবহ আকারে।

গত অর্ধশতকে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বাড়ার মাপে ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়া সারাদেশের জন্য প্রচ- হুমকি। এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে গত ৫২ বছরে দেশে সর্বাধিক তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নতুন এই গবেষণা তথ্যে উঠে আসছে অত্যধিক তাপপ্রবাহ জলবায়ুর চরম পরিবর্তনের সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ দাবদাহের চরম অনলে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক মাত্রাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না, প্রচ- হিমশিম খাচ্ছে। চরম ভাবাপন্ন এই রৌদ্রদাহে আক্রান্ত হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ স্বাস্থ্য আর কৃষি খাত। রোগ-বালাই বেড়ে যাওয়াও যেন প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ।

কলেরা, ম্যালেরিয়ার মতো দুঃসহ রোগ অত্যধিক দাবদাহকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত বলে বিভিন্ন গবেষণাপত্রের তথ্য-উপাত্তে নির্দেশিত হচ্ছে। এপ্রিল মাসে যে সাংঘাতিক তাপমাত্রা, তাতে কলেরা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াও পরিবেশ পরিস্থিতির নিষ্ঠুর ছোবল। অত্যধিক তাপমাত্রা নাকি মশাবাহিত রোগকেই ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। তেমন আলামত এপ্রিলের চরম উষ্ণতায় অনুধাবন করা যায়। আর ফলনের জমিকে কি মাত্রায় সংকটের মুখে ফেলে অত্যধিক দাবদাহ, তাও দৃশ্যমান হতে সময় লাগেনি।

কৃষিভিত্তিক ভূমিনির্ভর আবহমান বাংলাদেশ। তেমন সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলায় আজ দাবদাহের মরণ কামড়। ২০২১ সালেই তাপপ্রবাহে নষ্ট হয়েছে ২১ হাজার হেক্টরের বেশি ধান। ২০২৪ সালের হিসাব এখন অবধি অজানাই। তেমন হিসাব-নিকাশ উঠে এলে ক্ষতির পরিমাণও কতখানি, সেটাও এক আশঙ্কিত বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগাম সাবধান বাণী দিচ্ছে ২০৩০ সালে দাবদাহ কোথায় গিয়ে থামবে, সেটাও অজানা আশঙ্কার বিষয়। বরাবরের মতো এবারও দাবদাহের কারণ নির্দেশিত হয়েছে চারটি বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়। দেশের ভূপ্রকৃতিই প্রথম কারণ হিসেবে চিহ্নিত।

দ্বিতীয় ধাপে উল্লিখিত থাকে নিয়তই জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটময় পরিস্থিতি। তৃতীয় ধাপে বহুবার বলা অন্যতম বিষয় জীবাশ্ম জ্বালানি আর চতুর্থ হলো শিল্প-কারখানা থেকে অত্যধিক কার্বন নিঃসরণ। গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই এমন বিষবাষ্পের জঘন্য আলামতের ওপর পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সাবধান বাণীতে বিশ্বজোড়া আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন। যে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি বিশ্বকে আজ অবধারিত উন্নয়নের শীর্ষ শিখরে নিয়ে যায়, সেখানেই নাকি প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে তার দূষণের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু দাবদাহ উষ্ণভাবাপন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশ পরিস্থিতির অনুগামী হয়।

আবার অনেকটাই শিল্পোন্নয়নের গ্রিন হাউস অ্যাফেক্ট হিসেবেও বিবেচিত হয়ে আসছে। যেমনÑ আমাদের দেশে আম পাকার মৌসুমে রাজশাহীতে প্রচ- গরম পড়ে, সেটা মূলত মে মাসের শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাওয়াও স্বাভাবিক রৌদ্রদাহ বলে অঞ্চলবাসীর ধারণা। এটা সত্যও বটে। তবে রাজধানী ঢাকায় যে তাপমাত্রার আধিক্য, তা কিন্তু গত শতকের শেষ দুই দশকেও ছিল না। নির্দ্বিধায় বলা যায়, শিল্পনগরী ঢাকা উন্নয়ন অভিগামিতায় যতই এগিয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার দাবদাহের গতি।

যার সহজ সমীকরণ কার্বন নিঃসরণ অর্থাৎ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া। তবে প্রযুক্তি থেকে যে কার্বণ বাতাসকে দূষিত করে, সেখানে যদি নতুন নিসর্গ সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবন সম্ভব হয়, তাহলে দাবদাহের ঊর্ধ্বগতিকে লাগাম টেনে ধরা যাবে। এ তো গেল যান্ত্রিক সভ্যতার অবধারিত পার্শ্ব ও বিপরীত ক্রিয়া। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ আমাদের বাংলাদেশ। এখন আষাঢ় মাসের বিরামহীন বারিধারায় সারাদেশ অতিবৃষ্টি আর বন্যার প্রবল আশঙ্কায় যেন হিমশিম অবস্থায়। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলে পানির ঢল নেমে বিভিন্ন জায়গা প্লাবিত হয়ে যাওয়ার দুর্দশা সামনে প্রতীয়মানও হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ বিভিন্ন উপকূলীয়, উপদ্রুত এলাকায় বানভাসি মানুষদের বসতভিটা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়াও ঝর ঝর মুখর বাদর দিনের কাব্য ঝঙ্কার মোটেও নয়। বরং এক নিরেট চরম বাস্তবতার বিপরীত প্রতিবেশ। তেমন অসহনীয় দুরবস্থায় বিভিন্ন জায়গা প্লাবিত হওয়ার চিত্র চরম কোপানল। চা-শিল্প নগরী সিলেট এখন বন্যার পানিতে ভাসমান। ভারতের মেঘালয়ের ভারি বৃষ্টিপাতের ঢল নেমে সিলেট অঞ্চলে ঢুকে পড়াও প্রকৃতি পরিবেশের চরম নির্মমতা। প্রকৃতি যেমন দুই হাত ভরিয়ে কোলের সন্তানদের সুরক্ষিত রাখে, সেটাও এক অনিন্দ্য সুন্দর উপহার।

আবার রুষ্ট হয়ে বিপন্ন অবস্থা তৈরিতেও যেন এগিয়েই থাকে। ভাঙা-গড়ার খেলায় উন্মত্ত নির্মম নৈসর্গ প্রতিশোধেও যে অনেকটাই তছনছ করে দেয়, সেটাও প্রতীয়মান হতে সময় লাগে না। শুধু সিলেট নয়, নদ-নদীতে পানি বাড়ার কবলে নেত্রকোনায়ও। সংশ্লিষ্ট নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে এলাকা এক প্রকার পানিবন্দি অবস্থায়। সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চল পাহাড়ি ঢলে পাহাড় ধসের মতো দুরবস্থাকে মোকাবিলা করে এক অসহায় জীবনযাপন করছে বানভাসি মানুষ।

বন-বনাঞ্চলের শ্যামল সুশোভিত গাছের চমৎকার সারিবদ্ধ অবস্থান, সেখানেও সময় অসময়ে প্রকৃতি নয়, অঞ্চলবাসীরাই দুর্বিপাক ডেকে আনে। গাছ কেটে বনের যে দৈন্যদশা সেটা শুধু গভীর জঙ্গলের নয়-ছয় ছাড়াও পাহাড় ধসের আলামতেরও শিকড় প্রোথিত। গাছপালা কাটাকাটি করতে গিয়ে মাটির যে শক্ত ভিত, সেটা তো নড়ে ওঠেই। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পর্বতও পড়ে ভাঙনের মুখে। আবার পাহাড় কাটা মানুষেরও অভাব নেই এই দেশে। সেখানে প্রচ- বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙে পড়াও এক অবর্ণনীয় দুর্দশা।

পাহাড়ি এলাকা রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধ্বসের দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। যে মাত্রায় পার্বত্য এলাকায় সবুজঘেরা বনের হাজারো গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে মাটি তার শিকড় থেকে দুর্বল হয়ে যাওয়াও প্রকৃতির নিয়মবিধি। তার ওপর আঁচড় বসাতে নির্মম প্রতিশোধে প্রকৃতি উন্মত্ত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। 
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যার আশঙ্কায় আগাম প্রস্তুতির নির্দেশও দিয়েছেন। বন্যাকে বিবেচনায় এনে সতর্ক সাবধানতায় চলাফেরা করার, সকলে মিলেমিশে একসঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলানোর দায়-দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার আন্তরিক আহ্বান জানান তিনি। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি কোনোভাবেই সমানতালে চলছে না। কয়েক জেলায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কিছু এলাকায় বিপন্ন হওয়ার চিত্রও দৃশ্যমান। সিরাজগঞ্জের যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপরে ওঠায় প্লাবিত হচ্ছে চারপাশের ঘরবাড়ি। এদিকে নীলফামারীতে উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে।

এর প্রভাবে লালমনিরহাটের কয়েক উপজেলায় নদী পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চল জলাবদ্ধতায় আটকে পড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আবার আটকেপড়া কিছু পানিবন্দি জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অনেকটা স্বস্তিকর বিষয়। তবে সমূহ বন্যায় যে ক্ষতি সাধন তা চটজলদি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ সহজেই তৈরি হবে না। বানভাসি মানুষদের আপন ঠিকানায় স্থিতি হতেও প্রচুর সময় ব্যয় করতে হবে।

লাগাতার বৃষ্টি, বন্যা আর পাহাড়ি ঢলের মর্মান্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলানোয় কঠিন সময় পাড়ি দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর ক্ষতিগ্রস্ত  জনগোষ্ঠীকে। সেখানে শুধু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ নয়, বাস্তুভিটা থেকে যারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, তাদের একটি চিরস্থায়ী নিরাপদ আবাসনও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। সরকারি ত্রাণ তহবিল তো আছেই। সমাজে যারা বিত্তবান, তাদের আন্তরিক সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এক মানবিক দায়বদ্ধতা।

সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেরই নিজের মতো করে বাস্তুহারা, বানভাসি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। ইতোমধ্যে বানভাসি উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করা হয়েছে। এখানে যেন কোনো অসহনীয় দুরবস্থা তৈরি না হয়- সেটাই একান্ত কাম্য।
লেখক : সাংবাদিক

×