ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রয়োজন সততা-স্বচ্ছতা

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৭ জুলাই ২০২৪

রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রয়োজন সততা-স্বচ্ছতা

.

রাজস্ব ঘাটতি একটা মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে ঋণের বোঝা বহন করতে হচ্ছে সরকারকে। এমতাবস্থায় রাজস্ব বৃদ্ধি করতেই হবে। তা শুধুই ট্যাক্সনির্ভর রাজস্ব আয় অন্য অনেক দেশের জন্য এখন অনেক পুরনো বিষয় হয়ে গেছে। অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের রাজস্ব আহরণের ধরন উৎস বদলে গেছে। পরিবর্তিত অন্যতম বড় দুটি উৎস হলো ফি এবং মুনাফা বা ডিভিডেন্ট আয় থেকে রাজস্ব আয়। ট্যাক্সকে ভাগ করা হয় দুই ভাগে।

এক. যিনি ট্যাক্স দেন, তিনিই ভার বহন করেন। যেমনআয়কর। অন্যটা হলো ট্যাক্স দিচ্ছেন একজন, সেই ট্যাক্স সরকারকে দিচ্ছে আরেকজন। যেমনভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স ভ্যাট বা মূসক। ক্ষেত্রে ট্যাক্সের ভার বহন করছে যে সেবা বা পণ্য ক্রয় করল সে। কিন্তু সেই ট্যাক্সটা ক্রেতার থেকে সংগ্রহ করে প্রদান করছে ব্যবসায়ী বা দোকানি। যিনি সরকারি হিসেবে ভ্যাট-নামীয় ট্যাক্সটা জমা করছেন তিনি কিন্তু ট্যাক্সের কোনো ভার বহন করছেন না। এই দুই প্রকারের ট্যাক্সকে বলা হয় প্রত্যক্ষ কর এবং পরোক্ষ কর।  অন্য আরেকটা ট্যাক্স আছে, যেটা অতীতে অনেক দাপটের ছিল।

সেটা হলো কাস্টম ডিউটি বা আমদানি শুল্ক। একসময় বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলোর সরকারের জন্য ওই ট্যাক্স অতি মূল্যবান ছিল। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগই আসত সেই আমদানি শুল্ক থেকে। অর্থনীতি যতই উদারীকরণ হয়ে গ্লোবাল অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, ততই কাস্টম বা আমদানি শুল্ক কমে গেছে। অন্য দেশগুলোও এই ট্যাক্স কমাতে বাধ্য হয়েছে। আমদানি শুল্ক বেশি রাখলে ক্ষতি হয় বলে বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত পালন করতে গিয়েই শুল্ক কমাতে বাধ্য হয়েছে।

সরকারের জন্য রাজস্ব আয়ের অন্য উৎস হলো করের ওপর কর, নানাবিধ অতিরিক্ত বা সম্পূরক শুল্ক বা ট্যাক্স ইত্যাদি। সারচার্জ নামের অতিরিক্ত ট্যাক্সও সরকার আরোপ করতে পারে। কিছু শিল্প-ব্যবসাকে নিরুৎসাহ করতে সাধারণত সারচার্জ আরোপ করা হয়। ভ্যাট বা মূসকের ক্ষেত্রে কিছু পণ্য এবং সেবা ছাড় পাচ্ছে। অন্যগুলোকে বিভিন্ন হারে ভ্যাট দিতে হয়। তবে অনেক রেট থাকলে অসুবিধাও হয়। তাই ভ্যাট রেটকে ১০ শতাংশের মতো একটা ফ্ল্যাট রেটে আনা যায় কি না চিন্তা করা যেতে পারে। হোটেল-রেস্টুরেন্টের নানরুটির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। আবার বোতলজাত পানির ওপর কোনো ভ্যাট নেই। আমি এক রেস্টুরেন্ট থেকে নাশতার বিলটা নিয়ে তা- দেখলাম। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, রুটির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকতে পারলে বোতলের পানির ওপর কেন থাকবে না? কোনো যুক্তি হয়তো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে থাকতে পারে।

এখন ভ্যাট কালেকশনের জন্য ইলেক্ট্রনিক্যাল রেজিস্ট্রারার (ইসিআর) নামের একটা মেশিন আছে। যে মেশিন পেমেন্টগুলো রেকর্ড করে। তবে দোকানদারদের থেকে শুনলাম, কালেকটেড অর্থটা তাদেরই রাজস্ব বোর্ডের ব্যাংক হিসেবে জমা করতে হয়। এখানে সততার প্রশ্ন আছে। সব দোকানি সৎভাবে ইসিআরে রেকর্ডকৃত অর্থ জমা করছে কি না, কে জানে? অন্য প্রশ্ন হলো, এমন অনেক মধ্যমমান থেকে অপেক্ষাকৃত দামি হোটেল-রেস্তরাঁ আছে সেগুলোতে ইসিআর নামের কোনো মেশিনই নেই। আর এই মেশিন থাকলেই কি, অনেক দোকান মালিকই তাদের বিক্রয়কে রেকর্ডে আনতে চান না। তারা মুখে মুখে দরদাম করে বিক্রি করছেন। বড়জোর হাতে লিখে একটা রসিদ দিচ্ছেন। তাদের থেকে ভ্যাট পাওয়ার উপায় কী? উপায় হয়তো একটা আছে। সেটা হলো গ্রাহকদের ভ্যাট দেওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছা এবং দোকানদারদের থেকে ইসিআরে লিখিত রসিদ নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ গ্রাহক বেশি মূল্য দিতে হবে বলে কাজটা করে না।

অন্য উপায় হলো রাজস্ব বোর্ডের পরিদর্শকদের মাধ্যমে ইসিআরের ব্যবহার নিশ্চিত করা। ক্ষেত্রেও যেটা প্রয়োজন হবে সেটা হলো পরিদর্শকদের সততা। যেটার নাকি অনেক ঘাটতি আছে বলে দোকানিরাই বলেন। ভ্যাট নামের রাজস্ব আয় সরকার তখনই পাবে যখন লেনদেন রেকর্ডেই হবে। যারা কোনো রকমের রসিদ ছাড়া মালপত্র বিক্রি করছে তাদের ভ্যাটের আওতায় আনার উপায় কি? ধরনের লেনদেন যত বেশি বন্ধ করা যাবে তত বেশি রাজস্ব আয় সরকার পাবে। অন্য অনেক দেশ ক্যাশ বা নগদে লেনদেন করা অনেক কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ কি সেই পথে হাঁটবে।

ভ্যাট বা মূসক যদি ঠিকমতো আদায় করা যায়, তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে। সবার ক্ষেত্রে একই ট্যাক্স হওয়া উচিত নয়। যারা ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ করেন তাদের বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। অন্য বিষয়টা হলো, যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট কালেক্ট করে সরকারের হিসাবে জমা করে না, সেই কাজকে ন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হোক। স্বর্ণের অলংকারের একটা বড় বাজার আছে। ক্ষেত্রে স্বর্ণকার এবং দোকানিরা ঠিকমতো ভ্যাট দিচ্ছে তো? আমার তো মনে হয় বেশিরভাগ স্বর্ণ দোকানদার এই ট্যাক্স দেওয়ার ধারেকাছেও যায় না। রাজস্ব বোর্ডের উচিত হবে কোন খাত থেকে কত ভ্যাট পাচ্ছে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করা। যেসব রেস্তরাঁ-হোটেল ইসিআর মেশিন ব্যবহার করে না তাদেরও ন্ডে আওতায় আনা উচিত।

একদল প্রশিক্ষিত এবং সৎ ট্যাক্স কর্মকর্তা উদ্যোগ নিলে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বাড়াতে পারে। যেসব ব্যাংক সরকারের হয়ে ফি এবং ট্যাক্স কালেক্ট করছে, তারা ঠিক সময়ে রাজস্ব বোর্ডের ব্যাংক হিসেবে ওই সব আয় জমা করে কি? না করলে ওই সব ব্যাংকের নামও প্রকাশ করা যেতে পারে। বড় বড় কনভেনশন হল আছে। সেগুলোতে ৫০০ থেকে এক হাজার মেহমানকে অতি উত্তমরূপে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। ক্ষেত্রে  মেহমানপ্রতি ভ্যাট দেওয়া হচ্ছে কি? মেহমানপ্রতি এক হাজার টাকা ব্যয় হলে এক হাজার মেহমানের জন্য ব্যয় হবে ১০ লাখ টাকা। আর ১৫ শতাংশ হিসেবে ভ্যাট দিতে হলে যিনি আপ্যায়ন করছেন তাকে দিতে হবে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। রাজস্ব বোর্ড এসব অনুষ্ঠান থেকে এই রাজস্ব পাচ্ছে কি? অনেকে এক থেকে দুই কোটি টাকার মূল্যের গাড়ি ব্যবহার করেন। এসব গাড়ির যারা মালিক, তাদের ট্যাক্স ফাইলের অবস্থা কি? তারা যদি বলেন, গাড়ি তো তাদের নয় তাদের  মালিকানাকৃত প্রতিষ্ঠানের, তাহলে  দেখতে হবে ওই সব প্রতিষ্ঠান কি পরিমাণ ট্যাক্স দিচ্ছে!

কোনো লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে তো এক-দুই কোটি টাকা মূল্যমানের গাড়িই কিনতে দেওয়া উচিত নয়। কোনো বিশেষ ব্যবস্থায়ও শুল্কবিহীন গাড়ি কিনতে কাউকেই অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ে যারা আছেন, তারা আশা করি বিশেষ সুবিধা নেওয়ার আবর্ত থেকে বের হয়ে আসবেন। ওপরের নীতিনির্ধারকরা যদি নিজেদের আয়-ব্যয়গুলো পরিষ্কার রাখেন তাহলে সমাজে যারা বিভিন্নভাবে ফাঁকি দিচ্ছে তাদের ধরতে সুবিধা হবে। অন্য বিষয়টি হলো, সরকার শুধু বেশি বেশি রাজস্ব আয় করল, তাতেও সমাজ আনুপাতিকহারে উপকার পাবে না, যদি সরকারি ব্যয়গুলো জবাবদিহির মধ্যে না আসে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা জবাবদিহি বজায় রাখতে হবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর  কমিশনার পরিচালক-বাংলাদেশ

স্যাটেলাইট কোঃ লিঃ

×