ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি

ইটালো কালভিনোর একটি গল্প

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৬ জুলাই ২০২৪

ইটালো কালভিনোর একটি গল্প

ইটালো কালভিনোর জন্ম কিউবায়

ইটালো কালভিনোর জন্ম কিউবায়। বেড়ে উঠেছিলেন ইতালিতে। জন্ম : ১৯২৩ সালে। মৃত্যু : ১৯৮৫ সালে। কালভিনোর লেখা ‘নাম্বারস ইন দ্য ডার্ক অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বইটি কুড়িয়ে পেয়েছি রাস্তায়। ২৭৩ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক সংস্করণে ক্ষীণকায় বই। ভেতরে ছোট-বড় নানান দৈর্ঘ্যরে ৩৭টি গল্প। এর মধ্যে সপ্তম গল্পটির নাম : দ্য ব্ল্যাক শিপ। কালো ভেড়া। অতি ছোট্ট একটি গল্প। পৃষ্ঠা খানেক লম্বা। গল্পটি পড়ে রীতিমতো আঁতকে উঠেছি।

ধাঁধা লেগে গেছে এই ভেবে যে, ইটালো কালভিনো বাঙালি ছিলেন না তো! এবং গল্পটি সাম্প্রতিক সময়ে লেখা হয়নি তো? লেখকের লেখক পরিচিতিটি আবারও উল্টে-পাল্টে দেখলাম। নাহ, বাঙালি হওয়ার কোনো চান্সই নেই ভদ্রলোকের। তার ওপর গল্পটি লেখা হয়েছে ১৯৪৪ সালে, বাংলাদেশ নামক ভূখ- এবং সেই ভূখ-ে বে-নজীর ও ছাগল-কা- জন্মের বহুদিন আগে! ভণিতা বাদ রেখে, পুরো গল্পটি আমার ভাঙা অনুবাদে তুলে দিচ্ছি লন্ডনের চিঠির পাঠকদের জন্য। দেখুন তো, গল্পটি পড়ে আপনারাও আমার মতো কালভিনোকে বাঙালি ভাবতে শুরু করেন কিনা? গল্পটি হলো- ‘এক যে ছিল দেশ।

সে দেশের সবাই ছিল চোর। প্রত্যেকদিন রাতে, হাতে একটি লণ্ঠন আর কোমরে এক গোছা রামচাবি ঝুলিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ত। বেরিয়ে তার প্রতিবেশীর বাড়ি চুরি করতে যেত। ফিরে আসত ভোরে, প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে নানান চোরাই জিনিস হাতে করে। এসে দেখত- তার নিজের বাড়ি চুরি হয়ে গেছে।
দেশটিতে সবাই ছিল সুখী। কারও হতাশ কিংবা দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণই ছিল না।

প্রত্যেকে তার পাশের জনের জিনিস চুরি করত, তার পাশের জন তার পাশের জনের জিনিস, তার পরের জন তার পরের জনের- এভাবে যেতে যেতে একদম শেষ ব্যক্তিটি চুরি করত একদম প্রথম ব্যক্তি থেকে, অর্থাৎ সেদেশে চোর আর চুরি করার বেশ একটা চক্রাকার চেন তৈরি হয়েছিল। যার ফলে, কোথাও এতটুকু তালভঙ্গ হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ব্যবসাকাজে খরিদ্দার এবং ব্যবসায়ী- দুই পক্ষই অনিবার্যভাবে পরস্পর পরস্পরকে ঠকানোর কাজে তৎপর থাকত।

দেশের সরকারের মূল কাজ ছিল তার প্রজাদের কাছ থেকে চুরি করা, আর প্রজাদের তরফ থেকে সবসময়ে প্রচেষ্টা থাকত যে কোনোভাবে হোক সরকারকে প্রতারণা করে পার পেয়ে যাওয়ার। এভাবে, সেই চোরের দেশের জীবনযাত্রা বেশ শান্তিপূর্ণভাবে কেটে যাচ্ছিল। কেউ ধনী, কেউ গরিবÑ এমন কোনো ব্যাপার-স্যাপারের বালাই-ই ছিল না।
কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন সইল না। একদিন ঘটল বিপত্তি। এক সৎলোক- কোথা থেকে কিভাবে এলো সেই লোক, সে খবরটি আমরা জানি না, সেদেশে বাস করতে এলো। এবং সেদিন রাতের বেলা সবাই যখন চোরাই জিনিসপত্র বয়ে আনবার থলে এবং লণ্ঠন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, সে তার নিজ বাড়িতে বসে চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে বেশ আয়েশ করে বইপত্র পড়তে লাগল।

তার প্রতিবেশী যখন লোকটির বাড়িতে চুরি করতে এলো, সে দেখলÑ ঘরে আলো জ্বলছে, আর বাড়ির মালিকও বসে আছে ঘরে। ফলে, বেচারাকে চুরি না করে ফিরে যেতে হলো। এভাবে চলতে লাগল প্রতিদিন। শেষে দেশের লোকজন আর থাকতে না পেরে সৎ লোকটার কাছে গিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলল যে, সে যদি অন্যের বাড়ি চুরি-চামারি না করতে চায়Ñ সেটা তার বিষয়ে। কিন্তু তাই বলে অন্যদের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো তো তার ঠিক হচ্ছে না! রাতের বেলা তার নিজ বাড়িতে বসে থাকার মানে হচ্ছে অন্য কোনো পরিবারকে পরদিন না খেতে পেয়ে উপোস কাটানো- এ বিষয়টা তো তার বিবেচনা করা উচিত!
সৎলোকটি এমন যুক্তির বিরুদ্ধে খুব বেশি পাল্টা যুক্তি দেখাতে পারল না। অগত্যা, তার প্রতিবেশীকে চুরি করার সুযোগ করে দিতে সে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত এবং আর সবার মতোই পরদিন ভোরে ফিরে আসত, তবে সে কোনো বাড়িতে চুরি করত না। সৎমানুষ যেহেতু, বেচারা চাইলেও চুরি করতে পারত না! সে বড় জোর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বড়ব্রিজটার ওপরে গিয়ে দাঁড়াত, আর দাঁড়িয়ে নিচ দিয়ে ছুটে চলা পানির স্রোত দেখে দেখে সারারাত কাটিয়ে দিত। তারপর ভোরে যখন ঘরে ফিরে আসত, দেখত, কেউ একজন রাতে এসে তার ঘর লুট করে নিয়ে গেছে।

স্বভাবতই, এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বেচারা কপর্দকশূন্য হয়ে গেল। নিদেন খাবার জোগাড় করাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। জিনিসপত্র চুরি করতে গিয়ে শূন্য বাড়িটির চার দেয়াল পড়েছিল কেবল। কিন্তু যেহেতু এটা তার নিজের দোষে ঘটেছে, সুতরাং, ঐ দেশের জন্য এটা উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা ছিল না, বরং তার চুরি না করার স্বভাবটাই একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে শুরু করল। যেহেতু, সে অন্য কারোর বাড়ি থেকে কিছু চুরি করত না, অথচ অন্য কেউ একজন তার বাড়ি চুরি করতে আসত- তার ফল দাঁড়াল, প্রতিদিনই নাগরিকদের কেউ একজন সারারাত চুরি করে ঘরে ফিরে দেখত, তার ঘরের জিনিস যেমন ছিল তেমনি আছে, কোনোকিছু চুরি যায়নি-প্রথানুযায়ী যে বাড়িটি চুরি করার কথা ছিল ঐ সৎ লোকটির।
অচিরেই এমন চুরি না যাওয়া বাড়ির মালিকটি অন্যদের তুলনায় ধনী হয়ে উঠতে লাগল এবং ফলস্বরূপ সেই ধনী লোকটিও এক সময় আর রাতের বেলা অন্যের বাড়িতে চুরি করতে যাওয়া বাদ দিতে লাগল। এদিকে আরেক সমস্যা তৈরি হতে লাগল : যে লোকটা ঐ সৎলোকটির বাড়িতে চুরি করতে আসতে লাগল, সে ঐ বাড়িতে চুরি করার মতো কিছু না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে লাগল এবং অচিরেই গরিব হয়ে উঠতে লাগল।

ইতোমধ্যে, ধনী হয়ে ওঠা নাগরিকরা সৎ লোকটির মতো রাতের বেলা ব্রিজের উপরে গিয়ে নিচের ¯্রােতস্বিনী জলধারা দেখে সময় কাটাতে লাগল। আর এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ, দেশজুড়ে অনেক ধনী লোক এবং একই হারে অনেক গরিব লোক তৈরি হতে লাগল।
এখন, ধনী লোকেরা দেখল, তারা যদি প্রতিরাতে ব্রিজের ওপরে গিয়ে নদী দেখতে যায়, তবে অচিরেই তারা গরিব হয়ে পড়বে। তাই তারা ভাবল : আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়, আমরা কিছু গরিব লোককে ভাড়া করি, যারা আমাদের জন্য চুরি করে আনবে! এই চিন্তানুযায়ী, কখনো চুক্তি অনুযায়ী, কখনো নির্ধারিত বেতনে, কিংবা কখনো লুট করার সম্পদের পার্সেন্টেজ হিসাব করে ধনীরা গরিব লোককে তাদের জন্য চুরি করে আনতে নিয়োগ দিতে লাগল। অর্থাৎ, এই ধনীরা আরও চতুরতর চোর হয়ে উঠল, আর শীঘ্রই এর ফলস্বরূপ দেখা গেল, এই নতুন পন্থায় ধনীরা আরও ধনী হয়ে উঠতে লাগল, আর গরিবরা হয়ে উঠতে লাগল গরিবতর।
এদিকে কিছু কিছু ধনী নাগরিক এত বেশি ধনী হয়ে উঠল যে, তাদের আর চুরি করার কিংবা তাদের হয়ে চুরি করার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল, তারা যদি চুরি করা বন্ধ করে দেয়, তবে তারা আবার গরিব হয়ে যেতে থাকবে। কেননা, গরিবরা তাদের থেকে চুরি করে নিয়ে যাবে! সুতরাং, তারা সবচেয়ে গরিব নাগরিকদের তাদের সম্পদ রক্ষার জন্য পাহারায় নিযুক্ত করে দিল, আর কেউ চুরি করে ধরা পড়লে, তাদেরকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করল। তার মানে এভাবে তারা পুলিশ ফোর্স এবং হাজতখানা তৈরি করে ফেলল।
মোটকথা, সেই চোরের দেশে সেই সৎলোকটি বাস করতে শুরু করার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে লোকেরা লুট করা কিংবা লুণ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিল, এখন থাকল ধনী এবং গরিবÑ এই দুই শ্রেণি : তবে আদতে সবাই সেই ঘুরে-ফিরে চোরই। শুরুতে ছিল সেই একমাত্র সৎ লোকটি এবং অচিরেই সে না খেতে পেয়ে ক্ষুধায় মারা গেল!
...গল্পটি এখানেই শেষ! এবার বলুন,আমার যা মনে হচ্ছিল গল্পটি পড়ে, আপনাদেরও কি তা মনে হচ্ছে? কিন্তু না, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ গল্পটির শেষ বাক্যটার সঙ্গে একেবারেই একমত নই। অনেকের মতে, সংবাদ মিডিয়ার টিকে থাকার অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন, কেননা, আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আমাদের মস্তিষ্ক খারাপ সংবাদ দ্বারা আকৃষ্ট হয় বেশি।

জন গ্রিনের একটি কোটেশন তুলে দেই, A lot of times good news happens slowly and bad news happens all at once. And so we tend to focus on the bad news thatÕs crashing over us in waves, and not on the slwo long-term work that people are doing together to try to make a better world for us to share.’ অতএব, যত অন্ধকার মনে হচ্ছে, আলো আছে তার চেয়েও ঢের বেশি। প্রয়াত হুমায়ূন আজাদের কথার বিপরীতে আমার সবসময়কার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সবটা নষ্টদের অধিকারে যাবে না। অসম্ভব!


৪ জুলাই ২০২৪

[email protected]

×