ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

ওআইসির সাফল্য-ব্যর্থতা

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ৬ জুলাই ২০২৪

ওআইসির সাফল্য-ব্যর্থতা

ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি

ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থা। আগে সংস্থাটির নাম ছিল ইসলামি সম্মেলন সংস্থা। এটি মুসলিম বিশে^র ঐক্য ও সংহতির সংস্থা। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ৫৭টি দেশ প্রতিনিধিত্ব করছে। সংস্থাটির মতে, তারা মুসলিম বিশে^র সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি প্রচারের চেতনা নিয়ে মুসলিম বিশে^র স্বার্থ ধারণ ও সুরক্ষায় কাজ করে থাকে।

এই সংস্থা মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় স্থানগুলো শত্রুর কবলমুক্ত ও নিরাপদ রাখতে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব জোরদার করতে কাজ করে থাকে। ইসরাইল ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে, সমগ্র মুসলিম বিশে^ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় ওই বছর ২৫ আগস্ট ১৪টি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মিসরের রাজধানী কায়রোতে মিলিত হন। সৌদি আরব প্রস্তাব করে যে, যেহেতু বিষয়টি মুসলিম বিশে^র জন্য স্পর্শকাতর; তাই সব মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নিয়েই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করবে।

ওই বছরই ২২-২৫ সেপ্টেম্বর মুসলিম বিশে^র ২৪ জন রাষ্ট্রনেতা মরক্কোর রাবাতে মিলিত হয়ে মুসলিম দেশগুলো নিয়ে একটি সহযোগিতামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির ৩য় শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। মূল সংগঠন ছাড়াও ওআইসির ৬টি সহযোগী, ১৮টি অধিভুক্ত, ৭টি বিশেষায়িত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং ৪টি স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে।

এ ছাড়া সংগঠনটির ৪টি আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় ও ৬টি আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত। জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ওআইসির স্থায়ী প্রতিনিধি রয়েছে। 
ওআইসির ঘোষণায় সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে বলা হয়েছে। সদস্য দেশগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে পরস্পরের সহযোগিতা করবে; বিশেষত শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। এছাড়াও সংগঠনটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ওআইসি প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে না পারলেও সংগঠনটির অনেক প্রশসংসনীয় উদ্যোগ রয়েছে।

ওআইসি বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠন; যার অবস্থান জাতিসংঘের পরেই। ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ওআইসির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। প্রকল্পটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচারের ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। দেশগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহ ও নারীস্বাস্থ্যের উন্নতির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও বিশে^র যে কোনো প্রান্তে বসবাসরত মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য উপবৃত্তিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা লাঘব করার জন্য মুসলিম বিশ^ ও পশ্চিমাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ইস্তানবুলে একটি ধারাবাহিক বৈঠক করার জন্য সংস্থাটি প্রশংসিত হয়েছে। সংস্থাটি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে মানবিক অধিদপ্তর গঠন এবং ঘৃণা ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হিসেবে ভয়েস অব উইজডম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। সংস্থাটি জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তঃসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সম্পর্ক বজায় রেখেছে। 
কাজাখস্তানে একটি জাতীয় বৈজ্ঞানিক শীর্ষ সম্মেলন ২০১৬ সাল পর্যন্ত উদ্ভাবন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক কৌশল ঘোষণা করেছে। এটি ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকৃত মূল্যবোধ রক্ষার জন্য এবং ভুল ধারণা প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮১ সাল থেকে ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প, পারস্পরিক বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছে।

১৯৮২ সালে ওআইসি শিল্পমন্ত্রীদের বৈঠকে কৃষি যন্ত্রপাতিসহ শিল্পক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওআইসি বিভিন্ন সময়ে সোমালিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। কুয়েতে ইরাকের আগ্রাসনেরও নিন্দা জানিয়েছে সংস্থাটি। ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে সংস্থাটি একটি শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় যুদ্ধ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিকট আহ্বান জানিয়েছিল।

ফিলিস্তিনি জনগণের মুখপাত্র হিসেবে পিএলওকে স্বীকৃতি দান এবং সিনাই উপাত্যকার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়ে আসছে। যুদ্ধাহত মুসলমানদের সহযোগিতা করা ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করে থাকে ওআইসি।
তবে যে রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ওআইসির প্রতিষ্ঠা; সেক্ষেত্রে, এমনকি মুসলিম বিশে^র কোনো রাজনৈতিক সংকটে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সংগঠনটি। যেসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব খাটিয়ে বিশ^রাজনীতিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল ওআইসি; বর্তমানে সংগঠনটির নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর বড় অংশই সেসব দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মুসলিম স্বার্থ সুরক্ষার প্রশ্নেও তাদের ভূমিকা রহস্যজনক। ধনী ও নেতৃস্থানীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতা মুসলিম উম্মাহকে নতুনভাবে উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে ২০১৯ সালের ৩১ মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে সৌদি বাদশাহ মুসলিম দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ সৌদি আরব-ইরান সংকটের মূলে রয়েছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক আধিপত্য ও তেলের বাজার দখল নিয়ে।

নিজস্ব ও আঞ্চলিক স্বার্থের সংঘাতকে ওআইসির ঘাড়ে চাপানোর এই প্রবণতাকে অনেক বিশেষজ্ঞ বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, এতে করে সংগঠনের ঐক্য ও সংহতি সংকটে পড়বে। ১৯৯০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে মানবাধিকারবিষয়ক কায়রো ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন ও সুষম উন্নয়নের অঙ্গীকার করা হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওআইসির বেশির ভাগ সদস্য দেশে এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই রাজনৈতিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। এতে করে ওআইসির সম্মেলন ও অঙ্গীকার ঘোষণাসর্বস্ব বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংস্থাটি একদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ, অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিয়া-সুন্নি দূরত্ব বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে। বৈশি^ক মানের শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবনী সংস্থা গড়তেও ওআইসি তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। যদিও বিশে^র জ¦ালানি সম্পদের ৭০ ভাগ এই দেশগুলোতে রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় কৃত্রিম ‘ইসলাম-ভীতি’র প্রকোপ কমাতেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি সংস্থাটি। 
ওআইসিকে উম্মাহ ধারণার একটি আধুনিক সংস্করণ হিসেবে ধারণা করেছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। নিজ সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ রাখার পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়কে নিয়ে ওআইসির কমনওয়েলথধর্মী সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। জোটভুক্ত দেশগুলোতে যুদ্ধ ও আগ্রাসন থামাতেও ওআইসির কার্যকারিতা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। সৌদি আরবের অবরোধে ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষপীড়িত অবস্থা তার বড় সাক্ষী। ওআইসির নেতৃবৃন্দ শুধু উম্মাহর মানুষকে নিরাপদ রাখতে পারেনি তাই নয়, নিজেদেরও তারা অনেক সময় রক্ষা করতে পারেনি।

ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফির করুণ পরিণতি এর জ¦লন্ত প্রমাণ। সাদ্দাম হোসেন একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ইরানের বিপক্ষে লড়েছেন। আবার ইরান একসময় আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল। জোটের সদস্য দেশগুলো একেক সময় সেখানকার বিবদমান একেক শক্তিকে মদত দিচ্ছে। ওআইসিভুক্ত সকল দেশেরই নীতিগত বিভিন্ন স্ববিরোধিতা রয়েছে। পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসিকে সোচ্চার করতে চাইলেও তারা আবার চীনের উইঘুর মুসলমানদের বিষয়ে নীরব।

বসনিয়া-হার্জেগোভিনা সংকট, চেচনিয়া সংকট, কসোভো সংকট নিরসনে ওআইসি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ইরাকের কুয়েত দখলের ঘটনায় ওআইসি ছিল দ্বিধাবিভক্ত। নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রদান এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওআইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। উপসাগরীয় অঞ্চল, পশ্চিম সাহারা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা সৈন্যবাহিনী মোতায়েনের বিরুদ্ধে ওআইসি কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কোনো এক পক্ষকে সমর্থন না করে সদস্য দেশগুলোর উচিত হচ্ছে তা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।

একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মানবিক সংকট মোকাবিলায় মুসলিম দেশগুলোকে ওআইসির নেতৃত্বে একত্রিত হওয়া। অথচ মুসলিম বিশে^র সকল বিষয়েই ওআইসিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকে। ফলে, সংস্থাটি লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি। একইভাবে আফগানিস্তানে রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান থামাতে পারেনি। ওআইসির লক্ষ্য পূরণে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী স্বার্থ অন্যতম প্রধান বাধা। সদস্য দেশগুলোর একে অপরের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের মতো একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে।

পারস্পরিক বিবাদ কমাতেও ওআইসির কোনো সালিশি কাঠামো নেই। মুসলিম বিশে^র প্রায় সব রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সংকট বিরাজমান। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বিভক্তিও বিদ্যমান। একদিকে মধ্যপ্রাচ্য, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিচয়ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেও মধ্য এশিয়া, কিংবা গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা গালফ উপসাগরীয় অঞ্চল রয়েছে। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব রাষ্ট্রও এর আওতায় রয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এরূপ ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক বিভক্তিও সংহতি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

ওআইসির ব্যর্থতার সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন। ফিলিস্তিন সমস্যাটি ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে এখনো চলমান রয়েছে। ইসরাইলি বাহিনী কয়েকটি যুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোকে পরাজিত করে তাদের দখলকৃত ভূমিকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান না করে ইসরাইলকে ঘিরে মুসলিম বিশে^র ভেতরেও আমরা এক ধরনের বিভাজন লক্ষ্য করি।  

সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইসরাইলকে এক ধরনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে, ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ওআইসি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ওআইসিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মুসলিম বিশ^ তথা ওআইসি এক্ষেত্রে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। 
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় যে দুরবস্থা আমরা দেখছি, তা উদ্বেগজনক। ২০০৩ সালে ইরাকে পারমাণবিক বোমা আছে মর্মে ভুয়া অভিযোগ সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ ও ন্যাটো বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে। সিরিয়াতেও সন্ত্রাসবাদের নামে হস্তক্ষেপ করে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। লিবিয়াও গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। আফগানিস্তানেও বিশ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী অবস্থান করেছে। এমন দুর্দশায় ওআইসিভুক্ত অনেক দেশের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়।

সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক দূরত্ব আড়াল করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে ওআইসি বিভন্ন সময়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক সুশাসন, রাজনৈতিক ঐক্য, অঙ্গীকার ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নে সে সব পদক্ষেপেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে বহির্শক্তি বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির হস্তক্ষেপ মুসলিম বিশে^র ঐক্য ও সংহতির জন্য বড় বাধা।

অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখা তো দূরের কথা; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের কারণে সংকটগুলো আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ ধনী মুসলিম দেশগুলোর পেট্রোডলার এবং দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোর শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে পারত ওআইসি। মুসলিম বিশে^র উন্নয়ন, শান্তি, সংহতি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ওআইসিকে বর্তমান বিশ^ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় মুসলিম বিশ^ যদি ওআইসির ছায়াতলে এসে একই সঙ্গে কাজ করে এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা গেলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×