ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ৪ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি

বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই  নীতিকে ধারণ করে এগিয়ে চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদূরপ্রসারী এই বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি আজ অবধি বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে আলাদা বিশেষত্ব প্রদান করেছে। বিশ্ব মর্যাদায় উঁচুমার্গীয় অবস্থান নিশ্চিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ও গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির সুফল ঘরে আসার শুরুর মুহূর্তে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্য করে।

স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ৭০টিরও বেশি সহযোগিতামূলক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকার। এর পাশাপাশি এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ এক বিরল ইতিহাসের সাক্ষী হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে পৌঁছানোর পর পরই সেদিন সন্ধ্যায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিলÑ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রসঙ্গ। একটি দেশের আন্তর্জাতিক মহলে সুদৃঢ় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্ভর করে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির ওপর। 
একটি স্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি তখনই সফল হয় যখন তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ফলে দেশের সকল স্তরের জনগণ লাভবান হয় এবং সুদূরপ্রসারী হয়। বঙ্গবন্ধুর এই বন্ধুত্বপূর্ণ দর্শন মূলত তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের মুখ দেখে। যার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ।

তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরে বর্তমানে সেই দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির দুটি মূল বিষয়বস্তু হলোÑ অর্থনৈতিক কূটনীতি ও সর্বজনীন তথা পাবলিক কূটনীতি। এরই ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দেখা যায়Ñ ভারত ও অন্যান্য নিকট প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখা। জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় বৈশ্বিক সভায় বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষা।

ইইউ, জি সেভেন ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার অনুসন্ধান। বিদেশে কর্মসংস্থান, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট ও তৎপর থাকা ইত্যাদি। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন রূপকল্প-২০২১। একই সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প-২০৪১ এর ঘোষণা করেছেন তিনি। রূপকল্পদ্বয়ের লক্ষ্য সাধনে কার্যকর ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 
অর্থনৈতিক সাফল্যের উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখি, বিগত বছরগুলোতে কূটনৈতিক মিশনে বিদেশী সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সুসংহতের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। নতুন নতুন দেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এক নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে।

কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে চীনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য ও সেবার বাধামুক্ত প্রবেশ এবং দু’দেশের মধ্যে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। এ সব কিছুই সরকারের গৃহীত নীতি ও ভিশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। 
আলোচনার মাধ্যমে ওষুধ শিল্পে ট্রিপসের আওতায় স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য ট্রানজিশন পিরিয়ড ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশসমূহের চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সফলতা ও নেতৃত্বের প্রগাঢ়তা, পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপকতাকে তুলে ধরতে সহায়তা করছে। ২০১৪ সালে বলিভিয়ায় অনুষ্ঠিত জি-সেভেন প্লাস চায়না শীর্ষ সম্মেলনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অংশগ্রহণ করেন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের করণীয় নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ডাভোস শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবের এক অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। এই আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচির কথা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের দ্য ইনক্লুসিভ গ্রোথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট- ২০১৭ এ বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল ৭৯টি দেশের মধ্যে সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬, যা সূচকে প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ২০১৫ সালের ২৬-২৭ আগস্ট সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০১৫- এ অংশগ্রহণ করে। উক্ত সভায় বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনা ও পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
চীনের কুনমিংয়ে বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) ইকোনমিক করিডর শীর্ষক প্রথম আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এতে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল আঞ্চলিক দেশগুলোর অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বাণিজ্যের প্রসার এবং পিপল-টু-পিপল সংযোগের মাধ্যমে দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা।

জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন স্টেকহোল্ডারস কনসালটেশন অন সাবটেইনেবল সাপ্লাই চেইন শীর্ষক সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। সম্মেলনে দেশের বাণিজ্য, শিল্প, গবেষণা, এনজিও, শিল্প সংক্রান্ত কৌশল ও নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা হয়। বিগত ষোলো বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন অগণিত সাফল্যের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ, যা সুদূরপ্রসারী পররাষ্ট্রনীতি এবং যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কখনোই সম্ভব ছিল না। 
অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ দৃশ্যমান সাফল্যের ছাপ রেখেছে। ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৫০৩ মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ ডলারে। বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেই সমৃদ্ধি এবং সাফল্যের পথে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

এমনকি অতিমারি কোভিড-১৯ সংকটের সময়েও বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নসহ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রশংসিত দিক হলো এর বিশ্ব শান্তির দর্শন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকটকালীন সময়ে ১২ লাখ শরণার্থীর বিশাল কর্মযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়েও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাবার দেই, সুতরাং বিপদে পড়ে আমাদের দেশে আসা দুই-পাঁচ-সাত লাখ মানুষকে খাবার দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের আছে।’ চলমান ফিলিস্তিন ইস্যুতেও সব সময়ই মানবতার পক্ষে আছেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ সরকারের এই মানবিক এবং বৈশ্বিক দর্শনের মাধ্যমে এ দেশের পররাষ্ট্রনীতির মুকুটে শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, বরং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সুখ্যাতিও যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির অগ্রসরযাত্রা যেভাবে চলমান, সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আগামী পৃথিবীতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক, কূটনীতি ও অর্থনীতিতে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে। 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×