ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

হজরত আয়িশা সিদ্দীকার (রা.) পুণ্যস্মৃতি

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৪ জুলাই ২০২৪

হজরত আয়িশা সিদ্দীকার (রা.) পুণ্যস্মৃতি

প্রসঙ্গ ইসলাম

(গত শুক্রবারের পর)

গত সংখ্যায় আমরা মহীয়সী মহিলা হজরত আয়িশার (রা.) শাদী মোবারকের স্মৃতিবিজড়িত শাওয়াল মাসে তাঁর জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম। আয়িশার জীবন ও ইতিহাস ইসলামেরই ইতিহাস ও আমল। কারণ, নবীজীর নিকটতম লোক ও প্রিয়তম স্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর কক্ষেই আজকের মহানবীর (সা.) রওজা শরীফ অবস্থিত। একবার হজরত আয়িশা (রা.) স্বপ্ন দেখলেন যে, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি  চাঁদ ছুটে পড়ছে।

তিনি এ স্বপ্নের কথা পিতা আবু  বকরকে (রা.) বলেন। এরপর যখন রাসূলে কারীমের (সা.) ইন্তেকাল হয় এবং তাঁকে আয়িশার ঘরে দাফন করা হলো, তখন আবু বকর (রা.) মেয়েকে বললেন, তোমার স্বপ্নে দেখা সেই তিন চাঁদের একটি এই (অর্থাৎ তোমার ঘরে হুজুরের (সা.) মহান লাশের অবস্থান) এবং (তিন চাঁদের) সবচেয়ে ভালোটি। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে যে তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাঁদ ছিলেন আবু বকর  (রা.) ও  উমর (রা.)।
হজরত আবুবকর (রা.) মাত্র দুই বছর খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পান। হিজরি তেরো সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর যখন অন্তিম দশা তখন মেয়ে আয়িশা পিতার শিয়রে বসা। এর আগে সুস্থাবস্থায় তিনি মেয়েকে কিছু বিষয় সম্পত্তি ভোগ দখলের জন্য দিয়েছিলেন। এখন অন্য সন্তানদেরও বিষয় সম্পত্তির প্রয়োজনের কথা মনে করে বললেন : আমার কলিজার টুকরো মেয়ে! তুমি কি ঐ বিষয় সম্পত্তি তোমার অন্য ভাইদের দিয়ে দিবে? মেয়ে বললেন : অবশ্যই দিব। তারপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, রাসূলের (সা.) কাফনে কয়টি কাপড় ছিল? মেয়ে বললেন, তিনখানা সাদা কাপড়। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোন্ দিন ওফাত পান? বললেন, সোমবার।

আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি বার? বললেন : সোমবার। বললেন, তাহলে আজ রাতে আমাকে যেতে হবে। তারপর তিনি নিজের চাদরটি দেখালেন। তাতে জাফরানের দাগ ছিল। বললেন, এ কাপড়খানি ধূয়ে তার ওপর আর দুইখানি কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দিবে। মেয়ে বললেন, এই কাপড় তো পুড়ানো। বললেন, মৃতদের চেয়ে জীবিতদেরই নতুন  কাপড়ের প্রয়োজন বেশি। সেইদিন রাতেই তিনি ওফাত পান।

হজরত আয়িশার, হুজরার মধ্যে রাসূলের (সা.) পাশে একটু পায়ের দিকে সরিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হজরত আয়িশার হুজরায় পতিত এটা হলো দ্বিতীয় চাঁদ। এত অল্পবয়সে স্বামী হারানো মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি পিতাকে হারালেন।     
খলীফা হজরত উমারের (রা.) বাসনা ছিল, আয়িশার (রা.) হুজরায় রাসূলুল্লাহর (সা.) কদম মুবারকের কাছে দাফন হওয়ার। কিন্তু এ কথা তিনি লজ্জায় ও নানা সংশয় সংকোচে নবীপত্মীর কাছে ব্যক্ত করতে পারছিলেন না। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে এসব চিন্তায় তিনি বড় পেরেশান ছিলেন। শেষমেশ ছেলেকে পাঠালেন এই বলে যে, ‘উম্মুল মুমিনীনকে আমার সালাম পেশ করে বলবে, ‘উমারের বাসনা হলো তাঁর দুই বন্ধুর পাশে দাফন হওয়ার।’ আয়িশা (রা.) বললেন, ‘যদিও আমি ঐ স্থানটি নিজের জন্য রেখেছিলাম, তবে আমি সন্তুষ্টচিত্তে তাঁকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’
উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশার (রা.) এই অনুমতি পাওয়ার পরেও শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে উমার (রা.) অসীয়াত করে গেলেন, আমার লাশবাহী খাটিয়া তাঁর দরজায় নিয়ে গিয়ে আবার অনুমতি চাইবে। যদি তিনি অনুমতি দান করেন, তাহলে ভেতরে দাফন করবে। অন্যথায় দাফন করবে সাধারণ মুসলমানদের গোরস্তানে। খলীফার ইনতিকালের পর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হয়। আয়িশা (রা.) দ্বিতীয়বার অনুমতি দান করেন এবং লাশ ভিতরে নিয়ে দাফন করা হয়। আর এভাবে তিনি হলেন হজরত আয়িশার (রা.) স্বপ্নের তৃতীয় চাঁদÑ যার মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়। 
ব্যক্তিগত জীবনে হজরত আয়িশা (রা.) ছিলেন দানের ক্ষেত্রে খুবই দরাজ হস্ত। অন্তরটাও ছিল অতি উদার ও প্রশস্ত। বোন হজরত আসমাও (রা.) ছিলেন খুবই দানশীল। দুই বোনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দানশীলতা। আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা.) বলেন, তাঁদের দুইজনের চেয়ে বড় দানশীল ব্যক্তি আর কাউকে দেখিনি। তবে দুইজনের মধ্যে পার্থক্য এই ছিল যে, হজরত আয়িশা (রা.) অল্প অল্প করে জমা করতেন। যখন কিছু জমা হয়ে যেত, তখন সব এক সঙ্গে বিলিয়ে দিতেন।

আর হজরত আসমার (রা.) অবস্থা ছিল, হাতে কিছু এলে জমা করে রাখতেন না, সঙ্গে সঙ্গে বিলিয়ে দিতেন। হজরত আয়িশা (রা.) হিজরী ৫৮ সনের ১৭ রমজান মোতাবেক ১৩ জুন ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ বছর বয়সে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তখন হজরত আমিরে মুয়াবিয়ার খিলাফতকালের শেষ পর্যায়। ইতোপূর্বে কিছুকাল রোগগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এ সময় তিনি অসিয়ত করেন, আমাকে রাসূলুল্লাহর অন্য স্ত্রীদের সঙ্গে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করবে। মৃত্যু যদি রাতে হয়, তাহলে রাতেই দাফন করে দেবে। তার ওফাত হয় রাতের বিতর নামাযের পরে।

সুতরাং তখনই তাকে দাফন করা হয়। তার ইন্তেকালে ও জানাজায় আনসাররা ব্যাপকভাবে ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং শোকের শহরে পরিণত হয় মদীনা শহর। সত্যিই যেন তারা এক মহীয়সী মাকে হারালো। তখনকার মদীনা নগরীর গভর্নর আবু হুরায়রা (রা.) তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান। 
হজরত আমির মুয়াবিয়া (রা.) একদিন দরবারের এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা আপনি বলুন তো, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় ‘আলিম কে? লোকটি বলল, আমিরুল মুমিনীন! আপনি। আমিা মুয়াবিয়া (রা.) বললেন, না। আমি কসম দিচ্ছি, আপনি সত্য কথাটি বলুন। তখন লোকটি বলল, যদি তাই হয়, তাহলে আয়িশা (রা.)।
ইসলামের বিকাশ ও নবীজীর উসওয়ায়ে হাসানা বা উত্তম চরিত্রের অনুপম সাক্ষী ও ভাষ্যকার ছিলেন হজরত আয়িশা (রা.)। কুরআনের তাফসীর, হাদীসের বর্ণনা, ইসলামী আইন বা ফিকাহর সমাধান, সাহিত্য চর্চা সর্বক্ষেত্রে তাঁর দৃঢ় বিচরণ ছিল।

হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে এক বর্ণনায় হজরত আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা), আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.), জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা.) ও আনাস ইবন মালিক (রা.)-এর পর হজরত আয়িশার (রা.) স্থান। তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ২২১০টি। একবার সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উমর ফতোয়া দেন গোসলের সময় মেয়েদের চুলের খোঁপা খুলে চুল ভিজানো জরুরি। আয়িশা এ কথা শুনে বললেন, তিনি মহিলাদের একথা কেন বলে দেন না যে, তারা যেন তাদের খোঁপা কেটে ফেলে।

আমি রাসূলুল্লাহর সামনে গোসল করতাম এবং চুল খুলতাম না। (সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈ)। পোশাকের বিষয়ে শরীআতের বিধিবিধানের প্রতি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। একবার ভাতিজি হাফসা বিনতে আবদির রহমান মাথায় একটি পাতলা ওড়না দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি সেটা নিয়ে ছিড়ে ফেলেন এবং বলেন, তুমি জানো না আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরে কি বলেছেন। তারপর একটা পুরু ওড়না এনে তাকে দেন। (তাবাকাত ৮/৪৮)।

আরেকবার তিনি এক বাড়িতে মেহমান হিসেবে অবস্থান করেন। গৃহকর্তার বাড়ন্ত বয়সের দুটি মেয়ে ছিল। তিনি দেখলেন চাদর ছাড়াই তারা নামাজ পড়ছে। তখন বললেন, ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ে যেন চাদর ছাড়া নামাজ না পড়ে। (মুসনাদ ৬/৭৯৬)।
হজরত আয়িশা (রা.) আমাদের পারিবারিক জীবন, সাংসারিক ও দাম্পত্য জীবনে ইসলামের নিত্য অনুশাসন জানা ও মানার উত্তম আদর্শ। আমরা তাঁর জীবনাদর্শের চর্চা করলে ঘরে ঘরে মা আয়িশার প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হতো। (সমাপ্ত) 

লেখক:  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×