ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের গুরুত্ব

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ৪ জুলাই ২০২৪

আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের গুরুত্ব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত ও চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত ও চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একদিকে বাংলাদেশের বহু উন্নয়ন পরিকল্পনায় চীনের লজিস্টিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যদিকে, ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাও প্রয়োজন। তবে এই সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যে যাতে সাংঘর্ষিক কারণগুলো বড় হয়ে না ওঠে, বাধার সৃষ্টি না করে, সেজন্য শীর্ষ পর্যায়ে  আলোচনা দরকার

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করে শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততার নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারত এবং চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তাঁর নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক একীভূতকরণে অবদান রেখে চলেছে।

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই ভারত ও চীনের সঙ্গে এমন চমৎকার ‘ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক’ বজায় রেখে চলেছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে অভূতপূর্ব সহায়তা করেছে।

তাছাড়াও বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে সেটি যাতে ভারতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্যও পদক্ষেপ নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে চীন পুরোপুরি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করছে বলে মনে করা হয়। সেজন্য যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে, চীন তাদের সঙ্গেই কাজ করবে। এছাড়াও যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেজন্য চীনও চাইছে শেখ হাসিনার সরকারই ক্ষমতায় থাকুক। কারণ, তাতে প্রকল্পগুলো চলমান থাকবে এবং তাতে চীনের লাভ হবে। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সফরের গুরুত্ব অপরিসীম।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভারতীয় সমকক্ষ নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে নয়াদিল্লিতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। গত ২২ জুন নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতে ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর ভারতে কোনো সরকার প্রধানের এটিই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।

এটি ছিল ১৫ দিনের কম সময়ে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর। শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ১৪ অনুচ্ছেদের এই ঘোষণায় দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশি^ক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ভবিষ্যৎমুখী উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত এবং কর্মপন্থার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। ‘ডিজিটাল  অংশীদারিত্ব’ এবং ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে ভারত ও বাংলাদেশ কাজ করবে। এ লক্ষ্যে দুটি যৌথ কার্যক্রমের নথি সই করেছে বাংলাদেশ।

এ দুটি হলো- বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল অংশীদারিত্বের বিষয়ে অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশ-ভারত সবুজ অংশীদারিত্বের বিষয়ে অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ক নথি। স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের অন্যতম ফোকাস ছিল সমুদ্র সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের ২০৪১ এবং ভারতের ২০৪৭ রূপকল্পের মধ্যে সমন্বয় খুঁজে বের করা। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে সমুদ্র সহযোগিতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ওশেনস ইনিশিয়েটিভ ছাড়াও মেরিটাইম সহযোগিতা ও ওশানোগ্রাফি নিয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্যে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। 
আগে থেকেই বলা হচ্ছিল দুই দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণ করা হবে এই সফরের মাধ্যমে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও ভবিষ্যৎমুখী সহযোগিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়ানোর জন্য ‘সেপা’ (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) নিয়ে আলোচনা করতে ভারত রাজি। ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশীদের ই-মেডিক্যাল ভিসা দ্রুত চালুর ঘোষণাও তিনি প্রদান করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা চলমান রয়েছে।

এরই অংশ হিসেবে গত এক বছরে অনেক কাজ হয়েছে বলে নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন। দুই দেশ ও গোটা অঞ্চলের ভৌগোলিক নৈকট্যকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় রূপান্তর করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কানেক্টিভিটির উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট, ক্রস-বর্ডার বাণিজ্য ও ট্রানজিট অবকাঠামো রয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান।

১৯৭৬ সালের প্রারম্ভে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে কূটনীতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি পরস্পরের  বন্ধন অধিকতর দৃঢ়তা লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তিনি ১৯৫২ সালের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য চীন সফর করেন। সফরকালে তিনি চীনা বিপ্লবের প্রাণপুরুষ মাও সে তুং ও চৌ এনলাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চীনের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়।

কিন্তু আফসোসের বিষয় যে, চীন-বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। তবে চীন-বাংলাদেশ কূটনীতিক সম্পর্কের যে বীজ বঙ্গবন্ধুর হাতে রোপিত হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে চিরসবুজ হয়েছে। শেখ হাসিনার অগ্রসরমান নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে চীনের পাশাপাশি এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বাংলাদেশের একটি বড় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে।
বাংলাদেশ এবং চীনের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আগামী ৮-১১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যাচ্ছেন। ঢাকা সফররত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও ২৪ জুন দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত ১০ বছরে চারবার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে।

২০১৪ সালে বেজিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর, ২০১৬ সালে শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফর, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আবার বেজিং সফর এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে তাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এবার ৮ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত চার দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে শেখ হাসিনা বেজিং যাচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ৮-১১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বৃদ্ধি, ওষুধ, সিরামিকস, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্র প্রসার, চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অবকাঠামো নির্মাণ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।

বাংলাদেশ ও চীনের মাঝে বাণিজ্যঘাটতি নিয়েও জোরালো আলোচনা হবে। আমরা চীন থেকে আমদানি করি প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য। আর রপ্তানি করি মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। বিশাল এই বাণিজ্যঘাটতি কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিশাল বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়ে যাবে।
মোট কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত ও চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একদিকে বাংলাদেশের বহু উন্নয়ন পরিকল্পনায় চীনের লজিস্টিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যদিকে, ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাও প্রয়োজন। তবে এই সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যে যাতে সাংঘর্ষিক কারণগুলো বড় হয়ে না ওঠে, বাধার সৃষ্টি না করে, সেজন্য শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা দরকার।

অন্যদিকে, ভূরাজনীতিতে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের অবস্থানও মিত্র ও সাহায্যদাতা দেশগুলোর কাছে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। ভারত সফরের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর সেই আবশ্যকতা পূরণ করবে বলে প্রত্যাশা করছি।

লেখক : অধ্যাপক, উপাচার্য
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×