ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১

সঞ্চয়পত্রে ভোগান্তি কাম্য নয়

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ৩ জুলাই ২০২৪

সঞ্চয়পত্রে ভোগান্তি কাম্য নয়

সঞ্চয়পত্র নিয়ে মানুষের ভোগান্তি যেন শেষ হয় না

সঞ্চয়পত্র নিয়ে মানুষের ভোগান্তি যেন শেষ হয় না। সঞ্চয়পত্র ক্রয়, এর ওপর অর্জিত মুনাফা উত্তোলন, সঞ্চয়পত্র নবায়ন এবং এমনকি সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানোর সময়Ñ প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয় গ্রাহককে। কখনো জাতীয় পরিচয়পত্র, কখনো আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণ, আবার কখনো সঞ্চয়পত্র বিধির অনেক বিষয় নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা বা বিধির সীমাবদ্ধতা নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন।

সবাই যে সমসময় এই ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তা হয়ত নিশ্চিত করে বলা যাবে না, তবে অনেকেই যে প্রতিনিয়ত এ রকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক ধরনের ভোগান্তির কথা শোনা গেলেও সম্প্রতি সকল প্রকার সঞ্চয়পত্র ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করার ফলে একক এবং যৌথ নামে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে এক নতুন ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে, যার জন্য মানুষকে বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

সঞ্চয়পত্র যে ধরনের বিনিয়োগ সুবিধা তাতে এই ব্যবস্থা হওয়া উচিত খুবই সহজ এবং সাধারণ মানের, যাতে গ্রাহকের কোনোরকম ভোগান্তির সুযোগ না থাকে। সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব মানুষ, আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবী এবং অনেক ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, যাদের মূলত নিয়মিত উপার্জন নেই।

এই শ্রেণির মানুষ জীবনের শেষ সম্বলটুকু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। কোনো কারণে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা পেতে বিলম্ব হলে বা সঞ্চয়পত্র নবায়ন বা পুনঃবিনিয়োগ করতে বিলম্ব হলে তাদের মাসিক সাংসারিক খরচ চালাতে কষ্ট হয়। 
এ কথা অনস্বীকার্য যে, সঞ্চয়পত্র হচ্ছে অতি উচ্চ সুদের এক বিনিয়োগ ব্যবস্থা। দেশে ঝুঁকিমুক্ত যত বিনিয়োগ ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে সবচেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যায়। এ কারণেই মানুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ বেশি। এ কথাও ঠিক যে, সঞ্চয়পত্র সরকারের জন্য একটি ব্যয়বহুল অর্থ সংগ্রহের মাধ্যম। ঘাটতি বাজেটের কারণে সরকারের অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন আছে। কিন্তু উচ্চ সুদের হারে অর্থ সংগ্রহ করা সরকারের জন্য ক্রমেই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

তাছাড়া সরকারি বন্ডে কোনোরকম বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই বললেই চলে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, যেখানে বিনিয়োগ ঝুঁকি কম, সেখানে সুদের হার কম হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই মুদ্রাবাজারে বিরাজমান সুদের হারের চেয়ে কম সুদের হারে সরকার বন্ড বা ঋণপত্র বিক্রি করে অল্প সুদে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এসব কারণে সরকারের পক্ষে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ একটি ক্ষতিকর ব্যবস্থা। 
বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বিরাজমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে সঞ্চয়পত্রের মতো বিনিয়োগ সুবিধা একেবারে বন্ধ করাও সম্ভব নয়। প্রথমত, জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে সকল মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের সকল মানুষের পেনশন সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। সরকার মাত্র সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করেছে। এর সুফল পেতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

তৃতীয়ত, আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ক্ষুদ্র ব্যবসা, যাদের আপাতকালীন মূলধন সংরক্ষণের তেমন কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। ফলে সঞ্চয়পত্র সেই ব্যবস্থার বিকল্প। সার্বিক বিবেচনায় সঞ্চয়পত্র অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক নিরাপত্তার ভালো বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আপাত ক্ষতির কথা বিবেচনা করে সঞ্চয়পত্রের মতো উচ্চ সুদের বিনিয়োগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় বেড়ে যাবে।

তখন দেখা যাবে যে, সরকার সঞ্চয়পত্র বন্ধ করে সুদ বাবদ যে পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় বেড়ে গেছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এসব সঙ্গত কারণে সরকার কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এই বিনিয়োগ ব্যবস্থা বন্ধ করতে পারছে না। 
এক সময় হয়তো এই ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে সময় আসা পর্যন্ত এই উচ্চ সুদের বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু রাখতেই হবে। তবে ক্রমান্বয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ কমিয়ে আনতে হবে। সরকার সেই কাজটা শুরু করেছে এবং প্রত্যেকের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের একটা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণই মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে একজন ব্যক্তি একক নামে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ লাখ টাকা এবং যৌথ নামে এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারেন। পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এই সর্বোচ্চ সীমা ৪৫ লাখ টাকা।

তথ্যগুলো একজন ব্যাংকার আমাকে সরবরাহ করেছেন। তাই ভুল হলে পাঠক মার্জনা করবেন। এই যে একক ও যৌথ নামের এবং বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের জন্য যে ভিন্ন ভিন্ন সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখান থেকেই অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। অনেকে হিসাব করতেও ভুল করেন। আগে সঞ্চয়পত্র ডিজিটাল ছিল না, এমনকি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। তাছাড়াও একাধিক ব্যাংক এবং সঞ্চয় ব্যুরো থেকে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সুযোগ ছিল। ফলে অনেকেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, ভুল করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছেন। কেননা, এই হিসাব মেনে চলা আমাদের মতো সচেতন মানুষের পক্ষেই কষ্টকর। সেখানে সাধারণ মানুষ কিভাবে এই সর্বোচ্চ সীমা মেনে চলবে। 
এই সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দেয় সঞ্চয়পত্র পুরোপুরি ডিজিটালে রূপান্তর করার ফলে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একজনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ হয়। যারা ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছিলেন তারা পড়েছেন বিপদে। এই বিষয়টি নিয়ে একেক ব্যাংক বা সঞ্চয় ব্যুরোর অফিস থেকে একেক রকম ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে। কাউকে বলা হচ্ছে অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্রের ওপর অর্জিত সুদ প্রদান করা হবে না। অনেকে এও বলছেন যে, এই অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্রের অর্থই ফেরত দেওয়া হবে না।

অনেকে এমনও বলছেন, এক থেকে তিন বছরের মধ্যে এই অর্থ উঠিয়ে না নিলে তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা এসব মনগড়া বক্তব্য প্রদান করছেন এবং সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকছেন। এর ফলে অনেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এবং আতঙ্কিত হচ্ছেন, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। 
এ কথা ঠিক যে, যারা সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছেন তারা ভুল করেছেন। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কি ভুল করেনি? সঞ্চয়পত্র ডিজিটালে রূপান্তর করা একটি বড় ধরনের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে অনেকেই যে অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের কারণে সমস্যায় পড়বেন সেটা তাদের না জানা থাকার কথা নয়। তাই এই ধরনের নতুন পদ্ধতির প্রচলনের অনেক আগে থেকে গণসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো উচিত ছিল।

এরপরও যাদের অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র আছে তাদের সঞ্চয়পত্র উত্তোলনের সুযোগ দিতে হবে। এমনকি অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্রের ওপর কোনোরকম সুদ না দেওয়ার পরিবর্তে নামমাত্র, সম্ভব হলে ব্যাংকের এফডিআরের (ফিক্সড ডিপোজিট) সমান হারে সুদ প্রদান করা যেতে পারে। সরকার তো ঘাটতি বাজেটে আছে এবং এই অর্থ ব্যবহারও করেছে। তাই নৈতিকতার দিক থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে সরকারের এমন কি লাভ হবে।

এসব ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন এবং জনগণকেও সচেতন করতে হবে, যাতে ভুল বোঝাবুঝি বা অপব্যাখ্যার অবকাশ না থাকে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি না হয়। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ব্যবস্থা আরও সহজ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন সর্বোচ্চ সীমার পরিবর্তে মাত্র এক ধরনের সঞ্চয়পত্র এবং একজনের জন্য সর্বোচ্চ সীমা থাকা উচিত। 
সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয় দোষের বা বিধি বহির্ভূত হলেও, মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বরং এমনটি হবে এটাই এক ধরনের বাস্তবতা। সুযোগ থাকলে সুযোগের ব্যবহার/অপব্যবহার হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই হয়ে থাকে। একটি দৃষ্টান্ত দিলে অনেকেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। করোনা মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা যখন লকডাউন ঘোষণা করেছিল তখন মানুষ যাতে আর্থিক কষ্টে না পড়ে সেজন্য এখানকার সরকার কিছু প্রণোদনামূলক অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল।

কারা এ ধরনের সরকারি প্রণোদনা পেতে পারে তা নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দেওয়া সত্ত্বেও, অনেকেই এই শর্তের বাইরে গিয়ে এই প্রণোদনা গ্রহণ করেছে। যেহেতু সরকারের সংস্থার পক্ষে এসব যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ ছিল না তাই সরকারও গণহারে এই সুবিধা দিয়েছে এবং সমাজের একটি অংশ গ্রহণও করেছে। সরকার পরবর্তীতে বিষয়টি চিহ্নিত করেছে এবং একাধিকবার এই অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। কেননা, এতে জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায় এবং সরকার সেটা করতে পারে না।

মূল কথা হচ্ছে- জনগণের ভোগান্তি বৃদ্ধি পেতে পারে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাতে একটু ক্ষতি হলেও সেটা মেনে নিতে হবে। সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে জনগণের যে নতুন ধরনের ভোগান্তি শুরু হয়েছে, তা অতি সত্বর দূর করা প্রয়োজন।

লেখক : সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার
টরন্টো, কানাডা

[email protected]

×