ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর হোক

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২ জুলাই ২০২৪

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর হোক

দুর্নীতি আমাদের বড় জাতীয় সমস্যা

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২৩ সালের দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশি। যা আমাদের জন্য ইতিবাচক নয়। বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আগের বছর বাংলাদেশ ১৪৯তম দেশ হলেও এই বছর হয়েছে ১৪৭। তাই দুর্নীতিকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই

দুর্নীতি আমাদের বড় জাতীয় সমস্যা। গত পনেরো বছর দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে, তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। তবে দুর্নীতি যদি না থাকত, তাহলে দেশ এক অন্য পর্যায়ে যেতে পারত। যা দেখে অনেক দেশ আমাদের অনুকরণ করতে উৎসাহিত হয়। দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি নির্মূল না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে। সম্প্রতি দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র বের হচ্ছে,তা খুবই দুঃখজনক।

একের পর এক সর্বোচ্চ পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা দেখেশুনে সাধারণ মানুষ খুবই অবাক। এভাবেই যদি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা দুর্নীতি করে, তাহলে দেশের টেকসই উন্নয়ন কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? যেখানে যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দুর্নীতি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের আরও বেশি তদারকি বাড়াতে হবে। যেখানে সরকারপ্রধান দেশের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা খবুই প্রশংসনীয়। সেখানে সরকারি কর্মকর্তা লাগামহীনভাবে দুর্নীতি করে যাচ্ছে, যা অবশ্যই ঘৃণিত ও নিন্দনীয়। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিচার প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে দুর্নীতিবাজরা  রেহাই না পায়, সেদিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দেখুন কিভাবে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।

এমনকি ব্যাংক হিসাব থেকে টাকাও উত্তোলন করে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই আমরা এদের যাওয়ার কোনো সুযোগ করে দিচ্ছি কিনা, সেটা এখন বড় প্রশ্ন।  দুর্নীতি করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে, এটা যদি প্রমাণ করা যায়, তাহলে আর দুর্নীতি হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে অনেক সময়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ তদন্ত করে যদি বিচার নিশ্চিত করা যেত, তাহলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ আর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিফলন ঘটাতে পারত না।

এখন সরকারি কর্মকর্তাসহ উপাচার্যরা মনে করেন, সরকার একবার নিয়োগ দিলে, ঐ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁর চেয়ার থেকে সরকার অপসারণ করবে না। এজন্য তারা দিব্যি যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। দুর্নীতি বা অপরাধ করলে যে শাস্তি পাবে, এই ভীতিটা আমাদের মনে গেঁড়ে দিতে পারলে মানুষ আর দুর্নীতি করার সাহস দেখাবে না।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এত বেড়েছে, যা রীতিমতো সরকারকে বিব্রত করছে। দুর্নীতি কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থেই দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।  চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু দুর্নীতিও কমিয়ে আনতে হবে।

দুর্নীতি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। দুর্নীতি দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি। শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বস্তরের দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করা জরুরি। বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, লুটপাট ও অপচয়ের সুযোগ বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বড় প্রকল্পগুলোর কাজ বেশি করে তদারকি করতে হবে, যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারে। দুর্নীতি আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক  উন্নয়নের একটি ব্যাধি।

দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমকে গতিশীল করতে হবে।  
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২৩ সালের দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশি। যা আমাদের জন্য ইতিবাচক নয়। বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আগের বছর বাংলাদেশ ১৪৯তম দেশ হলেও এই বছর হয়েছে ১৪৭। তাই দুর্নীতিকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। 
রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে ৮২১ কোটি টাকা পাচারের সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশ হয়। এসবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গত কয়েক বছরে ৩৩টি তৈরি পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউস রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে এসব টাকা পাচার করেছে, যা খুবই দুঃখজনক। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

বিদেশে পাচার হওয়া টাকার বেশিরভাগই দুর্নীতি করা টাকা। অবৈধভাবে অর্জন করা টাকা বিদেশে পাচার করে ব্যবসা এবং বাড়ি-গাড়ি করছে অনেক অসাধু ব্যক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে, যাতে কেউ অবৈধভাবে টাকা দেশ থেকে পাচার না করতে পারে। অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে যেমন বাংলাদেশকে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হতো না, তেমনি দেশে রিজার্ভ সংকটও হতো না। প্রতিদিন যেভাবে বড় বড় কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায়, তা নিয়ে জাতি বিব্রত। এসব চোর আবার বড় বড় পদে বসে থাকে।

কর্তৃপক্ষের উচিত হবে নো কম্প্রোমাইজ। প্রশাসন ও পুলিশের সাবেক-বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ায় আতঙ্কে আছে বাকি দুর্নীতিবাজরা। তবে এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং অনেক সৎ-নৈতিক কর্মকর্তা। কারণ, এসব অসৎ কর্মকর্তার ক্ষমতার দাপটে  কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। খাদ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতি এবং সরকারি প্রায় সকল কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যেমনÑ খাদ্য কেনাবেচা, প্রশ্ন ফাঁস, নিয়োগ এবং প্রকল্পের কাজে দুর্নীতি। তাই দুর্নীতিকে না বলুন।
দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- নৈতিকতা, আচরণবিধি চালুকরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্যান্য পদক্ষেপ, যেমনÑ কেউ যদি সঠিকভাবে তার কাজ করে, তাকে পুরস্কৃত করা, দুর্নীতির ঝুঁকিগুলোর মূল্যায়ন ইত্যাদি। এছাড়াও প্রতিটি এলাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। যারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে তথ্য দিতে পারে এবং দুর্নীতি কমাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। সচেতনতা এবং জবাবদিহি দুর্নীতি কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। 
দুর্নীতি কমাতে দুর্নীতির উৎস উদ্ঘাটন করে যেখানে দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে, সেখানে দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সেখানে কোনো ধরনের অবহেলা করা যাবে না। অবহেলা করলেই দুর্নীতি বাড়বে। তাই দুর্নীতি দমন কমিশনকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে হবে। দলমতকে গুরুত্ব না দিয়ে, কেউ দুর্নীতি করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে পারলে সমাজে দুর্নীতি কমে যাবে।

দুর্নীতি করে কেউ যদি শাস্তি পায়, তাহলে অন্যরাও দুর্নীতি করার সাহস দেখাবে না। সবাই ভয়ে থাকবে, যা দুর্নীতি কমানোর জন্য সহায়ক হবে। তরুণ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে দুর্নীতি কমাতে এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাহলে আমরা সুখী-সমৃদ্ধ দেশ জনগণকে উপহার দিতে পারব। এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। 
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগ বেড়েছে। কিন্তু দুর্নীতি এখন সব স্তরেই। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দুর্নীতি করে, তাহলে দেশ কোথায় যাবে? রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকেই দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার দুর্নীতি দমন কমিশনেরও কিছুটা ঘাটতির অভিযোগ রয়েছে। তাই দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে। দুর্নীতি দমনের জন্য আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা ও বর্জন করতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, দুর্নীতিবাজদের চাটুকারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেজন্য চাটুকারদেরও ঘৃণা করতে হবে।  
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×