ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১

নোবেলের দেশ থেকে

ইইউ নির্বাচনে বর্ণবাদী দলের চড়াই-উতরাই

দেলওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২ জুলাই ২০২৪

ইইউ নির্বাচনে বর্ণবাদী দলের চড়াই-উতরাই

দেলওয়ার হোসেন

গত ৯ জুনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইউরোপীয় ইউনিয়নের দশম পার্লামেন্ট নির্বাচন। ৫ বছর আগে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। তার এক বছর পর ২০২০ সালে ব্রিটেন বিদায় নেওয়ার পর এই নির্বাচন সাধারণ কৌতূহলী মানুষের আগ্রহ, আকর্ষণ ও প্রত্যাশা হারিয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। নির্বাচনও হারিয়েছে তার জৌলুস। কমেছে ভোটার উপস্থিতিও। এমন পরিবেশের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এই নির্বাচন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য দেশ থেকে নির্বাচিত ৭২০ জন পার্লামেন্ট সদস্য ৭টি গ্রুপে বিভক্ত।

নিজ দেশ থেকে ই ইউ পার্লামেন্টের জন্য জনভোটে নির্বাচিত সদস্যদের বিভিন্ন দল থেকে সমমনা কিংবা সমঝোতার ভিত্তিতে গড়া ন্যূনতম ২৩ সদস্যের একটি গ্রুপ গঠন করে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করা হয়। প্রতিটি গ্রুপ তাদের সদস্য সংখ্যা এবং প্রতিনিধিত্বের আকার অনুযায়ী ন্যূনতম ৪০ মিলিয়ন ইউরোর একটি বিশাল ফান্ড পান। এটি গ্রুপের সদস্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
এই পার্লামেন্টে সর্ববৃহৎ এবং শক্তিশালী গ্রুপ জার্মান নেতৃত্বাধীন সেন্টার রাইট গ্রুপ। রুমানিয়া এবং পোল্যান্ডের কয়েকটি দল নিয়ে এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল প্রভাবশালী জার্মান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টি। গ্রুপে টেনে আনা হয়েছিল সোশ্যালিস্ট এবং লিবারেল রিনিউ ইউরোপ পার্টিকে সিনিয়র পোস্টগুলো বিতরণ করে। দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থানে ছিল স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার পার্টির গরিষ্ঠ সংখ্যার সদস্যের নেতৃত্বাধীন ব্লক (চৎড়মৎবংংরাব অষষরধহপব ড়ভ ঝড়পরধষরংঃং ধহফ উবসড়পৎধঃং)। কাতার স্ক্যান্ডাল এই গ্রুপটিকে তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেয়।
তৃতীয় অবস্থানে জোরালো নেতৃত্ব দেয় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর রেনেসা পার্টি। এবারের নির্বাচনে চরম ভরাডুবি হয়েছে তার দলের। কট্টর জাতীয়তাবাদী উগ্র ডানপন্থি দল মারি লি পেনের ন্যাশনাল র‌্যালি পার্টির কাছে। রেনেসা পেয়েছে ১৫ শতাংশ ভোট। ন্যাশনাল পেয়েছে তার দ্বিগুণ ৩০ শতাংশ ভোট। এই ভরাডুবি ম্যাক্রোঁর জন্য বিদায় ঘণ্টা এবং ই ইউ পার্লামেন্টের জন্য একটি অশনি সংকেত হয়ে ওঠে।

ফ্রান্সে মতুন জাতীয় নির্বাচন ও ম্যাক্রোঁ সরকারের পতন ধ্বনি যেন বেরিয়ে আসে খোদ ম্যাক্রোঁর মুখ থেকেই। নতুন নির্বাচনের ডংকা তিনিই বাজিয়ে বসেন গ্লানি ঢাকতে। কারণ, দেশে জাতীয় নির্বাচনের মতো অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জনগণের প্রতিফলিত রায় কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এর মধ্যেও প্রতিফলিত হয় সরকার ও নির্বাচনমুখী দলগুলোর জনপ্রিয়তা, অবস্থা ও অবস্থান। এই অবস্থায় ম্যাক্রোঁ  নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পিছপা হননি।

জনগণ যদি অন্য দলের প্রতি বেশি আস্থা জ্ঞাপন করে, তাহলে পূর্ণ মেয়াদকাল পার করার অনৈতিক ও অশোভনীয় চিন্তা করার অবকাশ নেই সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। শুধু ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সাফল্যের নজির রাখা মানেই দেশের পার্লামেন্টে গরিষ্ঠ আসন জয়ের সম্ভাবনা অকল্পনীয় কোনো বিষয় নয়। তাই ম্যাক্রোঁ সরকারের ভিত্তি ভীষণভাবেই নড়বড়ে হয়ে পড়ে নির্বাচনে বিপর্যয়কর ফলে।
৩০ জুনের প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই মারি লি পেনের দল বাজিমাত করেছে ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সেন্টারিস্ট এলায়েন্স ২০.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে বামপন্থিরা ২৮.১ শতাংশ ভোট জয় করে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং একই সঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উগ্র ডান শিবিরের ক্ষমতার বিস্তার এখন বেশ অস্বস্তি ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর ভেতর দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পলিসিতে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।
 ইউনিয়নের এই পার্লামেন্টের অধিবেশন বসে ফ্রান্সের স্ট্রাউসবার্গ এবং বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পার্লামেন্ট এটি। জুনে অনুষ্ঠিত ১০ম নির্বাচনে পার্লামেন্টে যেসব বিজয়ী গ্রুপ প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদের মধ্যে রয়েছে- বাম জোট (এটঊ/ঘএখ)-এর রয়েছেÑ ৩৯টি আসন, প্রোগ্রেসিভ এলায়েন্স অব সোশ্যালস্টস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস (ঝ ্ উ)Ñ ১৩৬টি আসন, গ্রীন অ্যান্ড ইউরোপীয়ান ফ্রি এলায়েন্স (এৎববহ/ঊঋঅ)Ñ ৫২টি, রিনিউ ইউরোপ গ্রুপÑ ৮০টি।

ইউরোপীয়ান পিপলস পার্টি অ্যান্ড ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (ঊচচ)Ñ ১৯০টি, ইউরোপীয়ান কনজারভেটিভ অ্যান্ড রিফর্মিস্ট পার্টি (ঊঈজ)Ñ ৭৬টি, আইডেন্টিটি অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি গ্রুপ (ওউ)Ñ ৫৮টি স্বতন্ত্রÑ নন এটাচড মেম্বার্স (ঘও) ৪৫টি। গ্রুপ ছাড়া নির্বাচিত অন্য সদস্যপদ ৪৪টি। এরা কোনো গ্রুপে নেই। স্বতন্ত্র।
পার্লামেন্টে সর্বমোট আসন সংখ্যা ছিল ৭৫১টি। ব্রিটিশ ডেলিগেশনের আসন ছিল ২৭টি। ১৯৭৯ সালের  নির্বাচনের পর ব্রিটেনের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩টি। ২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্রিটেনের এক্সিট (ইজঊঢওঞ) এর পক্ষে রায় প্রতিফলিত হওয়ার পর ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি বিদায় নেয় দেশটি, ই ইউ-এর সদস্যপদ থেকে। ব্রিটেন ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয়ান কমিউনিটির (ঊঈ) সদস্য ছিল। বিদায়ের পর পার্লামেন্টের ৪৬টি আসন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও এর মধ্য থেকে ১৫টি আসন পুনর্বহাল করা হয়। ফ্রান্স পেয়েছে ২টি বাড়তি আসন।

সুইডেন পেয়েছে ১টি। সব মিলিয়ে পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৭২০টি। প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে গ্রুপ ছাড়া এককভাবে জার্মানির রয়েছে ৯৬টি আসন। ফ্রান্সের ৮১। ইতালির ৭৬। স্পেনের ৬১। পোল্যান্ডের ৫৩। রুমানিয়ার ৩৩। নেদারল্যান্ডসের ৩১। বেলজিয়ামের ২২। সুইডেনের ২১।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর দলের মতো জার্মানির প্রভাবশালী গ্রিনপন্থিদেরও নাজুক অবস্থা। আধুনিক সুইডেনের রূপকার এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের কারিগর সুইডেনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি তাদের ৫টি আসন ধরে রেখেছে সপ্তম বারের মতো অনুষ্ঠিত ই ইউ-এর এই নির্বাচনে। ভোট বেড়েছে এক শতাংশের ওপর। আশাতীত ভালো করেছে সোশাল ডেমোক্র্যাটের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র বাম দল- ভ্যান্সতার পার্টি। আগের ৬.৮ শতাংশ থেকে এবার এক লাফে বেড়ে উঠেছে ১১.৬ শতাংশে।

ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান শরিক মডারেট দল কিছু বেশি ভোট ঝুলিতে ভরলেও অপর অনুগামী সমর্থক দল কট্টর ডানপন্থি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সুইডেন ডেমোক্র্যাটের ভোট কমেছে।   প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও ২টি আসন ধরে রেখেছে সেন্টার পার্টি। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট হারিয়েছে ১টি আসন। এই আসনটি গেছে বাম দলের ঘরে। ইয়োনাস সিওস্তাদের গ্রিন (মিলিও) পার্টি গতবারের চেয়ে দুই শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ভালো করেছে। তৃতীয় বৃহত্তম দলের স্থানে চলে এসেছে গ্রিন Progressive Alliance of Socialists and Democrats।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, সঙ্গী বাম দল ও গ্রীন মিলে ভোট পেয়েছে ৮ শতাংশ বেশি। ২০১৯-এর ই ইউ নির্বাচনে পাওয়া ২৩.৫ শতাংশ থেকে এবার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পেয়েছে  ২৪.৭৭ শতাংশ ভোট। আলামত বলছে- এই তিন দল ২০২৬ এর নির্বাচনে সরকার গঠন করার মতো পর্যায়ে প্রায় চলে এসেছে। জনমত অনুকূলে।

কট্টর ডানপন্থি নাৎসিবাদীদের অপপ্রচার- বিদেশীরা দূর হও, জার্মানি, জার্মানি স্লোগান অনুকূলে যায়নি। সুইডেন ডেমোক্র্যাট যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ক্ষমতার অংশীদার বনে গেছে, তা আরও বেশিদূর অগ্রসর হওয়ার মতো হাওয়া তেমনভাবে বইছে না অনুকূলে। ২০২৬-এর নির্বাচন পর্যন্ত অবস্থা কোন্দিকে মোড় নেয়, তা এত আগে অনুমান করা অসম্ভব।


স্টকহোম, ১ জুলাই, ২০২৪

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক

dehossaingmail.com

×